বৃহস্পতিবার

১ মে, ২০২৫
১৮ বৈশাখ, ১৪৩২
৩ জিলক্বদ, ১৪৪৬

রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যদের অনিয়ম দুর্নীতি: স্থায়ী ক্যাম্পাস হয়নি ৯ বছরে

সিরাজগঞ্জ প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ১৮ ডিসেম্বর, ২০২৪ ১৪:২৫

শেয়ার

রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় উপাচার্যদের অনিয়ম দুর্নীতি: স্থায়ী ক্যাম্পাস হয়নি ৯ বছরে
রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়। ছবি: প্রতীকী

সিরাজগঞ্জ শাহজাদপুরে রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করা হয়েছিল সাড়ে ৯ বছর আগে। তার পর দুজন উপাচার্য বিদায় নিয়েছেন। এখনও স্থায়ী ক্যাম্পাস হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, তারা নিজেদের আখের গোছানোর জন্য যতটা তৎপর ছিলেন, তার সিকিভাগও ব্যয় করেননি প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন চিন্তায়। প্রাক্তন উপাচার্য অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ ও অধ্যাপক শাহ আজমের বিরুদ্ধে অভিযোগ, ২০০ শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগে বাণিজ্য, স্বজনপ্রীতি, দলীয়করণ করেছেন। এর মাধ্যমে নিজেদের ভাগ্য দ্রুত বদলে ফেলেছেন তারা।

এখানে চাকরি পেয়েছেন প্রভাবশালী শিক্ষকদের শালাশালি, ভাই-ভাবিসহ নিকটাত্মীয়রা। অভিযোগ রয়েছে, আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীকে গণহারে চাকরি দিয়ে এখানে পুনর্বাসন করা হয়েছে।' দুই উপাচার্যের মতোই সাবেক রেজিস্ট্রার, বর্তমান ট্রেজারার, পরিচালক (অর্থ ও প্রশাসন), উপপরিচালক, শিক্ষক সমিতির সভাপতির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ রয়েছে।

তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে সম্প্রতি অভিযোগ দিয়েছেন শাহজাদপুরের অধিবাসী ড. জামিনুর রহমান। তিনি এর আগেও অভিযোগ দিয়েছিলেন। তবে এতদিন তা আমলে নেওয়া হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর অবশেষে নড়েচড়ে বসেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ও ইউজিসি। প্রাক্তন দুই উপাচার্যসহ অভিযুক্তদের অনিয়ম-দুর্নীতির বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ এবং স্থায়ী ক্যাম্পাস নির্মাণ দাবিতে শিক্ষার্থীরা নতুন উপাচার্যের কাছে সম্প্রতি স্মারকলিপিও দিয়েছেন।

উপাচার্যের নিয়োগ বাণিজ্য: অভিযোগ রয়েছে, সংগীত বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রওশন আলম, অর্থ ও হিসাব শাখার পরিচালক গোলাম সারোয়ার, ডেপুটি পরিচালক শিবলী মাহমুদ ও সাবেক রেজিস্ট্রার সোহরাব আলীর মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ বাণিজ্য সিন্ডিকেট গড়ে তোলেন প্রাক্তন উপাচার্য বিশ্বজিৎ ঘোষ। ওই সিন্ডিকেটের সহায়তায় ডেপুটি পরিচালক পদে শিবলী মাহমুদের স্ত্রী আসিফা সুলতানাকে, চিত্রগ্রাহক পদে শ্যালক হিল্লোল খানকে,  প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে ভগ্নিপতি রবিউল ইসলামকে, আপন ভাইয়ের শ্যালক আনিছুর রহমানকে কম্পিউটার অপারেটর পদে এবং নিজ গ্রামের সুজন শেখকে উপসহকারী লাইব্রেরিয়ান পদে চাকরি দেন বিশ্বজিৎ।

অপরদিকে ঢাকার কবি নজরুল কলেজের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সংগীত বিভাগের সহকারী অধ্যাপক রওশন আলমের বড় ভাই হাসান মুহাম্মদ রাসেলকে বয়স না থাকা সত্ত্বেও সেকশন অফিসার (অর্থ-হিসাব)। পদে, ভাবি আছিয়া খাতুনকে প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে, ছোট বোন সুলতানা জাহান ফেন্সিকে ক্যাশিয়ার (অর্থ-হিসাব) পদে এবং ছোট ভাই মোসলেম উদ্দিন নয়নকে চাকরি দেন। বিধিবহির্ভূতভাবে রওশনকে প্রথমে পাবলিক রিলেশন অফিসার (পিআরও), পরে পিএ এবং শেষ পর্যন্ত সংগীত বিভাগের শিক্ষক ও প্রক্টরাল কমিটির সদস্য বানান বিশ্বজিৎ ঘোষ। তবে রওশনের মন্তব্য, নিজ যোগ্যতায় ভাই-ভাবিসহ বাকিরা চাকরি পান।

সাবেক রেজিস্ট্রার সোহরাব আলীর বিরুদ্ধেও নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। তাঁর শ্যালিকা তানিয়া ইসলাম আইটি অফিসার ও ভাগ্নে লিটন নিরাপত্তা প্রহরী পদে চাকরি পেয়েছেন। প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা এইচটি ইমামের প্রার্থী রাশেদুল ইসলামকে প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে, সাবেক আইন সচিব দুলাল হোসেনের ভাইয়ের বউ সানজিদা হোসেন ও শ্যালক শাহনেওয়াজকে সেকশন অফিসার পদে নিয়োগ করা হয়। সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের স্ত্রীর আত্মীয় মোস্তাফিজুর রহমান সেকশন অফিসার, রাবির প্রাক্তন উপাচার্য 'অধ্যাপক আবদুল খালেকের প্রার্থী বকুল হোসেন অফিস সহায়ক পদে চাকরি পান। অর্থ ও হিসাব শাখার পরিচালক গোলাম সরোয়ারের বিরুদ্ধেও নিয়োগ বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে।

জানা গেছে, শাহজাদপুর ব্রজবালায় গ্রামের ২০-২৫ জন ১০ থেকে ১৫ লাখ টাকার বিনিময়ে চাকরি পান। গোলাম সরোয়ারের ভগ্নিপতি বুলবুল আহমেদের বয়স চল্লিশের ওপর। সে সময়কার সরকারি নিয়োগবিধি অনুযায়ী, নবম ও দশম গ্রেডে চাকরির সর্বোচ্চ বয়স ৩০ বছরের বেশি হতে পারবে না। তারপরও তিনি চাকরি পান। 

কোষাধ্যক্ষ (ট্রেজারার)‌। আবদুল লতিফ তাঁর শ্যালকপুত্র ইমরান খানকে সেকশন কর্মকর্তা ও ভাতিজা সুমন পারভেজকে অডিট অফিসার পদে চাকরি দেন। ইউজিসির জ্যেষ্ঠ সহকারী পরিচালক রবিউল ইসলামের ছোট বোন শিরিন আখতার এবং ভগ্নিপতি ওবায়দুল সেকশন কর্মকর্তা পদে ঢুকেছেন।

শিক্ষক নিয়োগে স্বজনপ্রীতি: ২০২৩ সালের ১৮ মে প্রকাশিত নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে অর্থনীতি বিভাগে প্রভাষক পদে শূন্য পদ একটি উল্লেখ থাকলেও নিয়োগ দেওয়া হয় তিনজনকে। সে সময় নিয়োগপ্রাপ্ত ৯ জন শিক্ষকের মধ্যে সংগীত বিভাগের বুলবুল আহম্মেদ ও তন্ময় পাল, বাংলা বিভাগে নূর-ই-নুসরাত এবং অর্থনীতি বিভাগের শামসুদ্দিন সরকার, মুহাম্মদ আশরাফ হোসেন ও ইসরাত জাহান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এবং প্রাক্তন উপাচার্য ড. শাহ আজমের ঘনিষ্ঠজন রাজশাহীর বাসিন্দা। বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাইনুল ইসলামের ক্ষেত্রেও শিক্ষাগত যোগ্যতার গরমিল ছিল। তাঁর দাবি, বিজ্ঞাপনের শর্ত অনুযায়ী, জিপিএতে দশমিক শূন্য ৫ নম্বর কম থাকলেও গবেষণালব্ধ অনুষঙ্গী বিশেষ অভিজ্ঞতা ছিল। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সবকিছু বিবেচনা করে তাঁকে নিয়োগ দেয়।'

জ্বালানির জন্য অতিরিক্ত বিল উত্তোলন: প্রাক্তন উপাচার্য শাহ আজমের জন্য প্রতি মাসে গড়ে ২০০ লিটার জ্বালানি তেলের বরাদ্দ হলেও বিধিবহির্ভূতভাবে ৪০০ থেকে ৬০০ লিটার ব্যবহার করতেন। তাঁর স্ত্রী নর্থ বেঙ্গল ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক লুবনা ব্যবহার করতেন রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রেজারার অধ্যাপক ফিরোজ মাহমুদের গাড়ি। অভিযোগ পাওয়া গেছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০ অনুষ্ঠানে নিজেই প্রধান অতিথি থেকে ১৯ লাখ টাকা সম্মানী নিয়েছেন প্রাক্তন উপাচার্য শাহ আজম।

নিজ দপ্তরের অ্যাপায়ন খরচের নামে ৬ লাখ টাকা, বিদেশি ডেলিগেট না এলেও আন্তর্জাতিক তিনটি সেমিনারের নামে প্রায় ১ কোটি ২০ লাখ টাকা, সিনেট সভায় বাইরের মাত্র চারজন অতিথি এলেও তাদের খরচের নামে ৪ লাখ টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়। শিক্ষার্থীদের গুচ্ছভর্তি পরীক্ষার ফির প্রায় ৩ কোটি টাকা বিধিবহির্ভূতভাবে ড. শাহ আজম নিজ অ্যাকাউন্টে রেখে শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ফকরুল ইসলাম ও গোলাম সরোয়ারসহ কয়েকজন ভাগবাটোয়ারা করেন।

দলীয়করণের অভিযোগ: আওয়ামী লীগের শতাধিক দলীয় কর্মীকে প্রাক্তন দুই উপাচার্য চাকরি দেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। শাহজাদপুরের প্রয়াত সংসদ সদস্য হাসিবুর রহমান স্বপনের ভাতিজি জামাই কোরবান আলী ও ভায়রার মেয়ে সাদিয়া জাবিন কান্তাকে সেকশন অফিসার পদে এবং শাহজাদপুরের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান অধ্যক্ষ আজাদ রহমানের ছেলে মাহমুদুর রহমান সজলকে কম্পিউটার অপারেটর কাম অফিস সহায়ক পদে চাকরি দেওয়া হয়। 

উপজেলা যুবলীগের আহ্বায়ক আশিকুল হক দিনারের স্ত্রী জান্নাতুন নাঈম প্রশাসনিক কর্মকর্তা। সলঙ্গা থানা ছাত্রলীগের সাবেক নেতা সাজেদুল ইসলাম নিরাপত্তা কর্মকর্তা, মারুফ হাসান সেকশন কর্মকর্তা ও মারুফের স্ত্রী সাদিয়া জেবিনও সেকশন কর্মকর্তা। উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি মারুফ হোসেনের ভাই সোহাগ অফিস সহায়ক।

কয়েক শিক্ষক ও কর্মকর্তা বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন পদে প্রথমে অস্থায়ী (অ্যাডহক)। ভিত্তিতে নিয়োগ দেওয়া হয়। পরে পছন্দের প্রার্থীর জন্য প্রয়োজনে বিজ্ঞপ্তিতে প্রার্থীর বয়স, অভিজ্ঞতা ও শিক্ষাগত যোগ্যতার শর্ত শিথিল করে তাদের স্থায়ী নিয়োগ দেওয়া হয়।

সমাজবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ফারহানা বাতেন বলেন, গত সাড়ে ৯ বছরেও শিক্ষার্থীদের নিজস্ব ভবন না থাকায় পাঠদান ব্যাহত হচ্ছে। শিক্ষক সমিতির সভাপতি বাংলা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ফকরুল ইসলাম দাবি করেন, শিক্ষক নিয়োগে স্বজনপ্রীতি হয়নি। মেধার ভিত্তিতেই হয়েছে। ড. জামিনুরের আবেদন ত্রুটিপূর্ণ থাকায় নাকচ করা হয়।

প্রাক্তন উপাচার্য বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেন, ‘আমার সময় গত চার বছরে কোনো অডিট আপত্তিও হয়নি। আমি আসার পর যারা ছিলেন, তারা অনিয়ম-দুর্নীতি করেছেন কিনা-তারাই ভালো জানেন।’

প্রাক্তন দ্বিতীয় উপাচার্য শাহ আজম বলেন, ‘আমার আমলে ৯ শিক্ষককে ন্যায্যতা ও স্বচ্ছতার ভিত্তিতেই নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ভর্তি পরীক্ষার ফি আমার অ্যাকাউন্টে রাখার তথ্যটি মিথ্যা।’

বর্তমান উপাচার্য অধ্যাপক এস এম হাসান তালুকদার বলেন, যাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ করা হয়েছে, তারা ক্ষমতায় থাকলে তদন্ত দুরূহ। যেখানে হাত দিই, সেখানেই বর্তমানে অসংগতি পাচ্ছি। আমি উপাচার্য হিসেবে এখানে যোগদানের পর দুদক ও মঞ্জুরি কমিশনের নথিপত্র পেয়েছি।'

সংগীত বিভাগের শিক্ষার্থী হৃদয় সরকার বলেন, রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয়েছে মূলত আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাকর্মীকে চাকরি দিয়ে প্রতিষ্ঠা করার এজেন্ডা নিয়ে।

২০১৭-১৮ শিক্ষাবছরে ৩৯৬ শিক্ষার্থী নিয়ে শুরু হয় বরীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম। বর্তমানে শিক্ষার্থী ১ হাজার ২০০ জন।'

banner close
banner close