যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যিক উত্তেজনার মধ্যে কৌশলগত ভারসাম্য পরিবর্তনের পথে হাঁটছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানির জেরে যুক্তরাষ্ট্রের শুল্ক আরোপ এবং হুশিয়ারির প্রেক্ষাপটে মোদী একদিকে চীন সফরে যাচ্ছেন, অন্যদিকে রাশিয়ায় পাঠাচ্ছেন তার শীর্ষ দুই নিরাপত্তা ও পররাষ্ট্র নীতিকর্তাকে। বিশ্লেষকদের মতে, এটি ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতিতে উল্লেখযোগ্য মোড় এবং বিকল্প জোট গঠনের কৌশলিক বার্তা।
আগামী ৩১ আগস্ট থেকে ১ সেপ্টেম্বর চীনের তিয়ানজিন শহরে অনুষ্ঠেয় সাংহাই কো-অপারেশন অর্গানাইজেশনের (এসসিও) শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিতে চীন সফরে যাচ্ছেন নরেন্দ্র মোদী। গালওয়ান উপত্যকায় চীন-ভারত সীমান্ত সংঘর্ষের পর এটি হবে মোদীর প্রথম চীন সফর। সর্বশেষ তিনি চীন সফর করেছিলেন ২০১৯ সালে।
২০২৪ সালের অক্টোবরে রাশিয়ার কাজানে ব্রিকস সম্মেলনের ফাঁকে চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে মোদীর একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এবারের সফরে তাদের মধ্যে আরেকটি পৃথক বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যা ভারত-চীন সম্পর্কে নতুন গতি আনতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপোড়েন
রাশিয়া থেকে তেল আমদানি অব্যাহত রাখায় ভারতের ওপর ২৫ শতাংশ নতুন শুল্ক আরোপের ঘোষণা দিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। এর ফলে ভারতের ওপর মোট শুল্কহার দাঁড়িয়েছে ৫০ শতাংশে—যা যুক্তরাষ্ট্রের কোনো বড় বাণিজ্য অংশীদারের ক্ষেত্রে অন্যতম সর্বোচ্চ। ট্রাম্প তার এক নির্বাহী আদেশে অভিযোগ করেছেন, ভারত রাশিয়া থেকে বিপুল তেল কিনে আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি করে লাভবান হচ্ছে, যা ইউক্রেন যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে মেনে নেওয়া যায় না।
নিজের সামাজিকমাধ্যম পোস্টে তিনি বলেন, “তারা (ভারত) যুদ্ধের কারণে মানুষ মরছে কিনা, তাতে বিন্দুমাত্র চিন্তা করছে না।”
সিএনবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ট্রাম্প বলেন, “ভারত সবচেয়ে বেশি শুল্ক আরোপকারী দেশ। আমি ২৫ শতাংশে স্থির ছিলাম, কিন্তু আগামী ২৪ ঘণ্টায় আরও বাড়িয়ে দেব।” হোয়াইট হাউজ জানিয়েছে, নতুন শুল্ক ৮ আগস্ট থেকে কার্যকর হবে।
রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক মজবুত করার তৎপরতা
যুক্তরাষ্ট্রের চাপের মধ্যেই মোদী তার জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভাল ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস. জয়শঙ্করকে রাশিয়ায় পাঠাচ্ছেন। দোভাল ৬ আগস্ট মস্কোর উদ্দেশ্যে রওনা হচ্ছেন এবং ৭ আগস্ট রুশ শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করবেন। যদিও সফরটি পূর্বনির্ধারিত, তবে বর্তমান ভূরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
বিশেষ সূত্রের বরাতে জানা গেছে, দোভাল রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গেও সরাসরি বৈঠক করতে পারেন। আলোচনায় রাশিয়া থেকে জ্বালানি তেল সরবরাহ, এস-৪০০ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অবশিষ্ট ইউনিট হস্তান্তর ও আফগানিস্তানের পরিস্থিতি বিশেষ গুরুত্ব পাবে।
অন্যদিকে, আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহে মস্কোতে অনুষ্ঠিতব্য ভারত-রাশিয়া আন্তঃসরকার কমিশনের বৈঠকে অংশ নেবেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্কর। বাণিজ্য, প্রযুক্তি ও কূটনৈতিক সহযোগিতা পর্যালোচনাভিত্তিক এ বৈঠকটি বিশ্লেষকদের মতে ট্রাম্পের শুল্ক আরোপের পাল্টা কৌশল হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে।
চীন সফরের কৌশলগত তাৎপর্য
এসসিও সম্মেলনে মোদীর অংশগ্রহণ শুধু আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়; বরং এটি ভারতের বৈশ্বিক কৌশলগত অবস্থান পুনর্গঠনের লক্ষ্যে নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। সীমান্ত উত্তেজনা প্রশমিত করা এবং দ্বিপাক্ষিক সংলাপ পুনরারম্ভের সম্ভাবনায় চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে মোদীর পৃথক বৈঠক নিয়েও আলোচনা চলছে। এই বৈঠকটি সফল হলে তা ভারত-চীন সম্পর্কের নতুন অধ্যায় রচনা করতে পারে।
একই সময়ে রাশিয়ার সঙ্গেও মোদীর উচ্চপর্যায়ের যোগাযোগ আরও ঘনিষ্ঠ হলে তা ভারত-রাশিয়া-চীন ত্রয়ী সম্পর্ককে মজবুত করার পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রনির্ভর কৌশলগত বলয় থেকে সরে আসার বার্তাও দেবে।
বন্ধুত্বের সমীকরণে পরিবর্তন?
নরেন্দ্র মোদী ও ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যে একসময় দৃঢ় রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত সম্পর্ক ছিল। ২০১৯ সালে টেক্সাসে আয়োজিত ‘হাউডি মোদী’ ও ২০২০ সালে ভারতের আহমেদাবাদে ‘নামাস্তে ট্রাম্প’ অনুষ্ঠানে সেই সম্পর্কের প্রকাশ দেখা যায়। তবে ট্রাম্পের দ্বিতীয় দফা প্রেসিডেন্ট হওয়ার পর তার একতরফা শুল্কনীতি এবং আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতিতে কঠোর অবস্থান দুই দেশের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করেছে।
বিশ্লেষকদের মতে, মোদীর সাম্প্রতিক কূটনৈতিক পদক্ষেপগুলো তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ার চেয়ে অনেক বেশি দূরদর্শী পরিকল্পনার অংশ। এর মূল লক্ষ্য হতে পারে একটি বিকল্প জোট গড়ে তোলা, যা যুক্তরাষ্ট্রের একাধিপত্য থেকে সরে এসে বৈশ্বিক পরিসরে ভারসাম্যপূর্ণ মিত্রতার ভিত্তি রচনা করবে।
সূত্র: হিন্দুস্তান টাইমস, এনডিটিভি, রয়টার্স
আরও পড়ুন:








