মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি এবং সামরিক উত্তাপ গত কয়েক দশকের মধ্যে সবচেয়ে বড় রূপ নেয় চলতি মাসের ১৩ জুন। দীর্ঘদিনের ছায়াযুদ্ধকে পেছনে ফেলে সরাসরি সামরিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়ে ইরান ও ইসরায়েল। ইসরায়েল আচমকা হামলা চালায় ইরানের সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনায়। এরপরই ইরানও পাল্টা ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন হামলা চালিয়ে ইসরায়েলের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা লক্ষ্য করে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়।
ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র ব্যালিস্টিক ডিফেন্স সিস্টেম আয়রন ডোম ভেদ করে পৌছে যায় তেল আবিব, জেরুজালেম এবং হাইফা শহরের বিভিন্ন স্থাপনায়। পাল্টা হামলায় ইসরায়েলের পক্ষেও ইরানের সামরিক অবকাঠামোয় বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি করা হয়।
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে যুক্তরাষ্ট্র বি-২ স্টিলথ বোমারু বিমান দিয়ে ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় বাঙ্কার বাস্টার এবং টমাহক ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে। এতে উত্তেজনা চরমে পৌছায়।
মার্কিন হামলার জবাবে ইরান সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যপ্রাচ্যের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ঘাঁটি কাতারের আল-উদেইদে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। কাতারের সরকার নিজেদের আকাশসীমা বন্ধ করে দেয় এবং বিমান চলাচল বন্ধ হয়ে পড়ে। তবে মার্কিন ঘাঁটি আগেই খালি করে নেওয়ায় বড় ধরনের প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনিকে গোপন বাঙ্কারে সরিয়ে নেয়া হয় এবং সেখান থেকেই তিনি হামলার অনুমতি দেন। ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে সরাসরি সম্প্রচার করা হয় হামলার গ্রাফিকস, যেখানে মার্কিন পতাকা জ্বলতে দেখা যায়। তবে ইরান স্পষ্ট জানায়, তারা কারও ক্ষতি করেনি। মূলত নিজেদের জনগণের কাছে শক্তি প্রদর্শনই ছিল মূল উদ্দেশ্য।
বিশ্ব যখন আশঙ্কায় দিন কাটাচ্ছে, তখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প সরাসরি ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু এবং ইরানের নেতাদের সঙ্গে কূটনৈতিক যোগাযোগ শুরু করেন। কঠোর আলোচনার পর ইরান ও ইসরায়েল ১২ দিনের যুদ্ধে সর্বাত্মক যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয়। ট্রাম্প নিজের সামাজিক মাধ্যমে লিখেন, অভিনন্দন বিশ্ব, এখন শান্তির সময়।
তবে যুদ্ধবিরতির সময়সীমা শুরু হওয়ার আগে ও পরে উভয়পক্ষই একাধিকবার হামলা চালায়। ইরান থেকে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রের জবাবে ইসরায়েল রাতভর হামলা চালায়। ইরানের উত্তরাঞ্চলের আস্তানে-ইয়ে আশরাফিয়ায় ইসরায়েলের হামলায় পরমাণু বিজ্ঞানীসহ ৯ জন নিহত হন। অন্যদিকে ইরানের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রে ইসরায়েলের বেরসেবা শহরে বহুতল ভবনে সরাসরি আঘাতে ৪ জন নিহত হন।
যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ইসরায়েল ইরানে পুনরায় বিমান হামলার প্রস্তুতি নেয়। খবর পেয়ে ট্রাম্প সরাসরি নেতানিয়াহুকে ফোন করে বোমা না ফেলার কথা বলেন। হোয়াইট হাউজ থেকে প্রকাশিত বার্তায় জানানো হয়, ট্রাম্প ইসরায়েল ও ইরান উভয়ের প্রতি অসন্তুষ্ট। তিনি বলেন, ‘এই দুই দেশ এত দীর্ঘ সময় ধরে যুদ্ধ করছে যে, তারা ভুলে গেছে কীভাবে শান্তি বজায় রাখতে হয়।’
সংঘাতের অবসান হলেও পুরো মধ্যপ্রাচ্যে এখনো চাপা উত্তেজনা বিরাজ করছে। ট্রাম্প ঘোষণা করেছেন, আগামী সপ্তাহে ইরানের সঙ্গে একটি সম্ভাব্য পারমাণবিক চুক্তি নিয়ে আলোচনা শুরু হবে। তবে ট্রাম্প স্পষ্ট জানিয়ে দেন, ‘চুক্তি হোক বা না হোক, তাতে আমার কিছু আসে যায় না। কিন্তু আমরা চাই, ইরানের হাতে আর পারমাণবিক অস্ত্র না থাকুক।’
মধ্যপ্রাচ্যে সাম্প্রতিক এই যুদ্ধ এবং তার পরবর্তী কূটনৈতিক টানাপোড়েন স্পষ্ট করে দিয়েছে, ইরান-ইসরায়েল উত্তেজনা শুধু দুটি দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এর প্রভাব পড়ছে পুরো বিশ্বে। আপাতত যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও, সবাই অপেক্ষায় এটি কতদিন টিকে থাকবে।
আরও পড়ুন:








