ইসরায়েল ১৩ জুন, শুক্রবার ভোরবেলা বিনা উস্কানিতে ইরানে আগ্রাসন শুরু করে। নিহত হয় ইরানের বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ সামরিক কমান্ডার, পারমাণবিক বিজ্ঞানী এবং সাধারণ মানুষ। এর পরই ইরানের সশস্ত্র বাহিনী শুরু করে অপারেশন ট্রু প্রমিজ থ্রি।
ইসরায়েলি হামলার পরপরই তাদের বিমানবাহিনীকে মোকাবিলায় বেশ কয়েকটি শাহেদ-১৩৬ কামিকাজ ড্রোন মোতায়েন করে ইরান। লক্ষ্য ছিল শত্রুপক্ষের বিমান অভিযান ব্যর্থ করা। এবং অবশ্যই যুদ্ধের প্রস্তুতির জন্য সময় পাওয়া।
ওই দিন স্থানীয় সময় রাত প্রায় ১১ টার দিকে ইরান অধিকৃত অঞ্চলগুলোতে প্রথম ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শুরু করে। এই হামলায় ফাত্তাহ, খেইবার শেকান, এমাদ ও কদরের মতো বিভিন্ন ধরনের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র অন্তর্ভুক্ত ছিল। ইসরায়েলের কৌশলগত সামরিক ও গোয়েন্দা লক্ষ্যবস্তুতে নির্ভুলভাবে আঘাত হানে এগুলো।
হামলার প্রাথমিক লক্ষ্য ছিল তেল আবিব ও ইসারায়েলের বিমান ঘাঁটিগুলো। ইসরায়েলের নেভাটিম বিমানঘাঁটি থেকে ইরানকে লক্ষ্য করে হামলা চালানো হয়। তাই এই ঘাঁটি ছিল ইরানের মূল লক্ষ্যবস্তু। এই হামলাগুলোতে সাফল্যের কারণেই আলোচিত হয়ে ওঠে ফাত্তাহ ক্ষেপণাস্ত্র। সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হওয়া এই হামলাগুলো যেমন ইরানের দক্ষতার প্রতীক তেমনি ইসরায়েলের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অকার্যকরতার প্রকাশ।
পরের হামলাটি হয় রাত ৩টায়। লক্ষ্য ছিল হাইফা ও আশদোদের অর্থনৈতিক ও সামরিক অবকাঠামো এবং ইলাতের বন্দর। এই হামলাগুলিতে খেইবার শেকান ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ও ড্রোন ব্যবহার করা হয়। তৃতীয় দফা হামলা হয় ভোরের দিকে। তেল আবিবের কাছে গোয়েন্দা সদর দপ্তর এবং নেগেভ মরুভূমিতে সামরিক ঘাঁটিতে হানা দেয় ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র। এই হামলাগুলির লক্ষ্য ছিল ইসরায়েলের অপারেশনাল ক্ষমতাকে পঙ্গু করে দেয়া এবং এর কমান্ড চেইন ভেঙে দেয়া। আয়রন ডোম ও ডেভিডস স্লিং-এর মতো ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলিকে বাধা দিতে ব্যর্থ হয়। ইরান তরল জ্বালানিযুক্ত এমাদ ও কদর ক্ষেপণাস্ত্রও ব্যবহার করে।
এই ব্যর্থতার কারণ হলো এই সিস্টেমগুলো স্বল্প ও মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের জন্য তৈরি, ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের জন্য নয়। এই ব্যর্থতার পরই ইসরায়েলি সরকার কঠোর সেন্সরশিপ আরোপ করে, দখলকৃত অঞ্চলগুলিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলার ভিডিও প্রকাশ নিষিদ্ধ করা হয়। জনসাধারণের ধারণা, নিয়ন্ত্রণ এবং বসতি স্থাপনকারীদের মধ্যে ব্যাপক আতঙ্ক রোধ করার জন্য এই পদক্ষেপ নেয়া হয়। তবে, সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচারিত ছবি এবং ভিডিওগুলিতে, বিশেষ করে তেল আবিবে, নগর ও সামরিক অবকাঠামোর ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি প্রকাশ পেয়ে যায়।
ইসরায়েল ক্ষতির প্রকৃত পরিমাণ গোপন করার জন্য হতাহত এবং ধ্বংসের খবর গোপন করেছে। ১৮ জুন দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসরায়েলের অ্যারো ৩ ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা কাজ করছে না। যে ইরানি ক্ষেপণাস্ত্র ঠেকাতে পারছে না তারা। এই প্রতিবেদনে নিশ্চিত করা হয়েছে, ইরানের অবিরাম ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় বেকায়দায় পড়েছে ইসরায়েল। তেল আবিবের কেন্দ্রস্থল এবং স্টক এক্সচেঞ্জ ভবনে হামলার প্রমাণ দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদনকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলে।
এই অভিযানের সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক প্রভাব রয়েছে। যা একটি শক্তিশালী আঞ্চলিক শক্তি এবং সামরিক ঘাঁটি হিসেবে ইরানের অবস্থানকে দৃঢ় করে তোলে। ইরানের সবচেয়ে উন্নত অপারেশনাল হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলির মধ্যে একটি, ফাত্তাহ-১। এই ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের পাল্লা ১ হাজার ৪০০ কিলোমিটার। এটি ইসরায়েলের গভীরে কৌশলগত লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে সক্ষম। ফাত্তাহ-১ তার টার্মিনাল ডাইভ পর্যায়ে ১৩ থেকে ১৫ ম্যাক অর্থাৎ প্রতি ঘণ্টায় ১৬ হাজার থেকে ১৮ হাজার কিলোমিটার গতিতে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানে। এ কারণেই ইসরায়েলের আয়রন ডোম, ডেভিডস স্লিং এবং অ্যারো ৩ এর মতো বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার মাধ্যমে এটিকে বাধা দেয়া সম্ভব হয় না।
ফাত্তাহ-১ কঠিন জ্বালানি ব্যবহার করে, যা উৎক্ষেপণের প্রস্তুতির সময়কে কমিয়ে দেয়। ক্ষেপণাস্ত্রের ওয়ারহেডের ওজন প্রায় ৪৫০ থেকে ৫০০ কিলোগ্রাম এবং বিস্ফোরক বা ক্লাস্টার গোলাবারুদ বহন করতে পারে। এর নির্ভুলতা পাঁচ মিটারের মধ্যে। ইরানের দাবি, বিশ্বের কোনো বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ফাত্তাহ-১ কে আটকাতে পারবে না। এই দাবি সাম্প্রতিক অভিযানে ইসরায়েলের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার ব্যর্থতার মাধ্যমে প্রমাণিত হয়েছে।
ইরানের অস্ত্রাগারে থাকা আরেকটি মধ্য-পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র গাদর। এই তরল জ্বালানির ক্ষেপণাস্ত্রটি শাহাব-৩ পরিবারের অংশ। একে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র অস্ত্রাগারের ভিত্তিপ্রস্তর বলা হয়ে থাকে। আনুমানিক ১ হাজার ৩৫০ থেকে ১ হাজার ৯৫০ কিলোমিটার পাল্লার এই গাদর ক্ষেপণাস্ত্রটি ইসরায়েলের গভীরে যে কোনো লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে সক্ষম। এর ওয়ারহেডের ওজন ৬৫০ থেকে ১ হাজার কিলোগ্রামের মধ্যে। এটি গুচ্ছ বোমা বহন করতে পারে। আয়রন ডোম এরও মোকাবিলা করতে পারে না। এটি তরল জ্বালানি ব্যবহার করে।
আরেকটি মধ্য-পাল্লার ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এমাদ। ২০১৫ সালে তৈরি এমাদ-এর আনুমানিক পাল্লা ১ হাজার ৭০০ কিলোমিটার। ইসরায়েলের কৌশলগত লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত করতে সক্ষম এটি। এর ওয়ারহেডের ওজন প্রায় ৭৫০ কিলোগ্রাম। গাদরের মতো, এমাদ তরল জ্বালানি ব্যবহার করে। এটি ক্লাস্টার গোলাবারুদসহ বিভিন্ন ওয়ারহেড বহনে সক্ষম।
শীর্ষ কমান্ডার নিহত কাসেম সোলাইমানির নামে নামকরণ করা ইরানের নতুন কঠিন জ্বালানিযুক্ত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলির মধ্যে একটি হজ কাসেম। আনুমানিক ১ হাজার ৪০০ কিলোমিটার পাল্লার এই ক্ষেপণাস্ত্রটির ওয়ারহেডের ওজন ৫০০ থেকে ৭০০ কিলোগ্রামের মধ্যে। হজ কাসেমের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য হলো এর কঠিন জ্বালানি-চালিত চালিকাশক্তি। যা প্রস্তুতির সময়কে উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে দেয়। এর দ্রুত, অতর্কিত উৎক্ষেপণ সম্ভব।
খেইবার শেকান ক্ষেপণাস্ত্র সাম্প্রতিক অভিযানে ধ্বংসাত্মক ক্ষমতার জন্য আলোচনায় এসেছে। ২০২২ সালে তৈরি ক্ষেপণাস্ত্রটির আনুমানিক পাল্লা ১ হাজার ৪৫০ কিলোমিটার। এর ওয়ারহেডের ওজন প্রায় ৪৫০ কিলোগ্রাম। কঠিন জ্বালানির ব্যবহার প্রস্তুতির সময়কে কমিয়ে দেয়।
এই অভিযানেই প্রথমবারের মতো দূরপাল্লার সেজ্জিল ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবহার করা হয়। এটি দুই স্তর বিশিষ্ট, কঠিন জ্বালানিযুক্ত ক্ষেপণাস্ত্র। যার আনুমানিক পাল্লা ২ হাজার থেকে আড়াই হাজার কিলোমিটার। এটি ৫০০ থেকে ১ হাজার কিলোগ্রাম ওজনের ওয়ারহেড বহনে সক্ষম এবং ইরানের সবচেয়ে উন্নত অস্ত্রগুলির মধ্যে একটি। ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা এগুলো ঠেকাতে পারে না।
ফাত্তাহ-১, কদর, এমাদ, হাজ কাসেম এবং খেইবার শেকানের মতো ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের ব্যাপক ব্যবহারের পাশাপাশি, ইরানের সশস্ত্র বাহিনী ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার উপর বহুমাত্রিক চাপ প্রয়োগের জন্য শাহেদ-১৩৬, আরাশ-১ এবং আরাশ-২ সিরিজসহ উন্নত কামিকাজে ড্রোন ব্যবহার করে।
এই ড্রোনগুলি, তাদের অনন্য নকশা এবং বৈচিত্র্যময় অপারেশনাল কৌশলসহ, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের পাশাপাশি একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিপূরক ভূমিকা পালন করে। শাহেদ-১৩৬ -এর উৎপাদন খরচ কম এবং কম উচ্চতায় উড়াতে সক্ষম। আনুমানিক ২০০০ কিলোমিটার পরিসীমা এবং ৪০ থেকে ৫০ কিলোগ্রাম ওজনের ওয়ারহেড বহন করার ক্ষমতা সম্পন্ন এই ড্রোন আয়রন ডোমের মতো স্বল্প-পাল্লার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার উপর চাপ সৃষ্টি করে।
সাম্প্রতিক অভিযানে শাহেদ-১৩৬ ড্রোন দলবদ্ধভাবে উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল। এই কৌশলটি ইসরায়েলের বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে পুরোপুরি বিভ্রান্ত করে। যার ফলে সহজেই ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রগুলো সফল হয়।
আরাশ-১ এবং আরাশ-২ ড্রোন উচ্চ গতি এবং ভারী ওয়ারহেড বহনে সক্ষম। আনুমানিক ১ হাজার ৫০০ কিলোমিটার পাল্লা এবং ঘণ্টায় ৬০০ থেকে ৮০০ কিলোমিটার গতিবেগের আরাশ-১, ১০০ কিলোগ্রাম বিস্ফোরক ওয়ারহেড দিয়ে সজ্জিত। এরই আরও উন্নত রূপ আরাশ-২। এর ২,০০০ কিলোমিটার পাল্লা এবং ১৫০ কিলোগ্রাম ওয়ারহেড রয়েছে।
ফাত্তাহ-১, কদর, এমাদ, হাজ কাসেম, খেইবার শেকান এবং সেজ্জিলের মতো উন্নত ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রের সমন্বিত ব্যবহার, শাহেদ-১৩৬, আরাশ-১ এবং আরাশ-২ এর মতো কামিকাজ ড্রোনের পাশাপাশি, বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রের নকশা এবং উৎপাদনে ইরানের প্রযুক্তিগত দক্ষতা কেবল প্রদর্শনই করেনি বরং ইসরায়েলের অত্যাধুনিক বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে পরাস্ত করার ক্ষেত্রে দেশটির সুনির্দিষ্ট এবং সমন্বিত কৌশলও তুলে ধরেছে।
ইসরায়েলের আয়রন ডোম, ডেভিডস স্লিং এবং অ্যারো ৩ বিমান প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ইরানি ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র এবং ড্রোনকে বাধা দিতে ব্যর্থ হয়েছে। বিশেষ করে হাইপারসনিক গতি, রাডার স্টিলথ এবং ক্লাস্টার ওয়ারহেড ব্যবহারের মতো বৈশিষ্ট্যের কারণে, ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা নেটওয়ার্কের কাঠামোগত দুর্বলতাগুলি প্রকাশ পেয়েছে।
আরও পড়ুন:








