
ইরানের ইসলামি বিপ্লবী গার্ড বাহিনীর (আইআরজিসি) প্রধান কমান্ডার মেজর জেনারেল হোসেইন সালামি শুক্রবার (১৩ জুন) ইসরায়েলি বিমান হামলায় নিহত হন। এ হামলা তেহরানে ইরানের সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনায় চালানো হয়। এটি ইসরায়েল-ইরান দ্বন্দ্বে এক নতুন ও বিপজ্জনক পর্বের সূচনা বলেই ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা।
সালামি তার কঠিন বক্তব্য ও কৌশলী সামরিক পরিকল্পনার জন্য পরিচিত ছিলেন। ইরানের প্রতিরক্ষা ও সামরিক কর্মকাণ্ডের গুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনাকারী ছিলেন তিনি। ২০২৪ সালের এপ্রিল মাসে তিনি ইসরায়েলের ওপর ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পরিকল্পনায় নেতৃত্ব দেন, যা ছিল দামেস্কে ইরানি দূতাবাসে ইসরায়েলি হামলার প্রতিশোধ।
ইরানের সামরিক নীতির প্রধান রূপকার
প্রথম জীবন ও আইআরজিসি-তে যোগদান: হোসেইন সালামির জন্ম ১৯৬০ সালে, ইরানের ইসফাহান প্রদেশের গোলপায়েগান শহরে। ১৯৮০ সালে ইরান-ইরাক যুদ্ধ শুরুর সময় তিনি আইআরজিসিতে যোগ দেন। সেই সময় তিনি কলেজে পড়ছিলেন, কিন্তু যুদ্ধক্ষেত্রে সাহসিকতা ও নেতৃত্বের জন্য দ্রুত পদোন্নতি পান।
তিনি কারবালা ও ১৪তম ইমাম হোসেন ডিভিশনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন এবং পরে নৌবাহিনীর ‘নুহ সদর দপ্তরের’ দায়িত্ব পান।
শিক্ষা ও কৌশলগত দায়িত্ব: যুদ্ধের পর তিনি ইরানের সামরিক স্টাফ কলেজ থেকে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাপনায় মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেন। এরপর ১৯৯৭ থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত আইআরজিসি’র অপারেশন প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় ইরানের সামরিক কৌশল ও নীতি অনেকটাই গঠিত হয়।
ডেপুটি থেকে প্রধান কমান্ডার: ২০১৯ সালে, এক দশক ধরে ডেপুটি কমান্ডার হিসেবে কাজ করার পর, সালামিকে আইআরজিসি-এর প্রধান কমান্ডার হিসেবে নিয়োগ দেন আয়াতুল্লাহ খামেনি। এই পদ তাকে ইরানে সামরিক দিক থেকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ক্ষমতাধর ব্যক্তি বানায়।
আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা ও সমালোচনা
সালামির নেতৃত্বে ইরানের ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র কর্মসূচি চালু ও বিস্তৃত হয়। এর কারণে তাকে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়তে হয়। ২০০৬ সালে জাতিসংঘের নিষেধাজ্ঞা, ২০০৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা, ২০২১ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের নিষেধাজ্ঞা (২০১৯ সালের বিক্ষোভ দমন ঘিরে) ও ২০২৩ সালে ফ্রান্সে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের হয়, মাহসা আমিনির বিক্ষোভ দমনের সময় হত্যার হুমকির অভিযোগে।
কট্টরপন্থি ভাবাদর্শ ও যুদ্ধনীতি
সালামি শুধু একজন সেনা কর্মকর্তা নন, তিনি ছিলেন কঠোর ধর্মীয় ও রাজনৈতিক মতাদর্শের অনুসারী। তিনি নিয়মিত ইসরায়েলের ধ্বংসের আহ্বান জানাতেন এবং যুক্তরাষ্ট্রকে প্রকাশ্যে আক্রমণ করতেন। তিনি বলেন, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্রই আমেরিকান বিমানবাহী রণতরীর শেষকথা।
২০২৪ সালে, সালামির নেতৃত্বেই ইরান প্রথমবারের মতো সরাসরি মিসাইল ও ড্রোন হামলা করে ইসরায়েলের ওপর, যা মধ্যপ্রাচ্যে এক নতুন যুদ্ধ যুগের সূচনা করে।
আইআরজিসির শক্তি
আইআরজিসি-এর প্রধান হিসেবে সালামি এমন একটি বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন যাদের নিজস্ব বিমান ও নৌ বাহিনী, গোয়েন্দা ইউনিট ও প্রায় ২ লাখ সেনা ছিল। আইআরজিসি শুধু সেনা নয়, ইরানের নির্মাণ, তেল, টেলিকম এবং গাড়ি শিল্পের বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করে।
ইসরায়েলি হামলা
শুক্রবার ভোররাতে ইসরায়েল একটি বড় সামরিক অভিযান চালায়। তারা তেহরানের পারমাণবিক ও ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনা লক্ষ্য করে এ হামলা করে। এই হামলায় হোসেইন সালামি এবং আরও কিছু উচ্চপদস্থ ইরানি সামরিক কর্মকর্তা ও পরমাণু বিজ্ঞানী নিহত হন।
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন, এই হামলার উদ্দেশ্য ছিল ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির চেষ্টা থামানো। ইরান এর প্রতিশোধ হিসেবে ১০০টির বেশি ড্রোন ইসরায়েলের দিকে পাঠায়। তবে ইসরায়েল সেইসব ড্রোন আকাশেই ধ্বংস করে দেয়।
ইরানের প্রতিক্রিয়া
সালামির মৃত্যুর পর ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি বলেন, ইসরায়েলকে কঠিন প্রতিশোধের মুখোমুখি হতে হবে।
আইআরজিসি এক বিবৃতিতে জানায়, সালামি ছিলেন ইসলামি বিপ্লবের একজন বীর কমান্ডার এবং তার পথ অনুসরণ করা হবে। এই ঘটনা ইরানের সামরিক নেতৃত্বের জন্য বড় ধাক্কা। বিশ্লেষকরা বলছেন, এর ফলে ইরান ও ইসরায়েলের মধ্যে সংঘর্ষ আরও বাড়তে পারে এবং এতে পুরো মধ্যপ্রাচ্য প্রভাবিত হতে পারে।
সালামি তার সময়কালে ইরানের সামরিক শক্তি বাড়ানোর কাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। তিনি ইরানের প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা ও মধ্যপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তারে বড় ভূমিকা পালন করেছেন। ইরান এখন এক শীর্ষ সামরিক নেতাকে হারিয়ে শোক পালন করছে। বিশ্বের দৃষ্টি এখন মধ্যপ্রাচ্যের দিকে, কারণ এই ঘটনাটি যে বড় কিছু ঘটাতে পারে তা সবাই বুঝতে পারছে।
তথ্যসূত্র: গালফ নিউজ
আরও পড়ুন: