
পবিত্র ঈদুল আজহা মুসলিমদের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় উৎসব। ১০ জিলহজ সারা বিশ্বে মুসলিমরা এই ঈদ উদ্যাপন করেন। সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্য এবং এর বাইরে অনেক দেশেই ৬ জুন ঈদ উদ্যাপিত হচ্ছে। পবিত্র ঈদুল আজহার মূল বিষয় একই থাকলেও বিভিন্ন দেশের মুসলিমরা নিজস্ব রীতিনীতি আর সাংস্কৃতিক আবহে এই ঈদ উদ্যাপন করেন।
এই ঈদে আল্লাহর সন্তুষ্ট করার নিয়ত করে গরু, ছাগল, ভেড়াসহ অন্যান্য গবাদিপশু কোরবানি দেওয়া হয়। কোরবানির মাংস পরিবার, আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব ও দরিদ্রদের সঙ্গে ভাগ করে নেওয়া হয়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে অনেক সাধারণ ঐতিহ্য থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন দেশের মুসলিমরা ঈদ উদ্যাপনের বাড়তি রীতিনীতি গড়ে তুলেছেন।
মধ্যপ্রাচ্য

ইয়েমেন থেকে সিরিয়া পর্যন্ত সব দেশে ঈদ উদ্যাপনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি তৈরি করা। এসব দেশের বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষের আবার আলাদা আলাদা ঐতিহ্যবাহী খাবার আছে।

এসব খাবার শুধু ঈদের জন্যই রান্না করা হয়।
ঈদে সবাই নতুন ও সুন্দর সুন্দর পোশাক পরেন। বাহরাইনের রাজধানী মানামার দোকানগুলোয় ঐতিহ্যবাহী ঢিলেঢালা পোশাক ‘জালাবিয়া’র বিক্রি বেড়ে যায়। এ ছাড়া ঈদ উপলক্ষে লিবিয়ার অশ্বারোহীরা নতুন পাগড়ি ও জোব্বা পরে বের হন।


এশিয়া
এশিয়ার পূর্ব এবং দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে পবিত্র ঈদুল আজহা উদ্যাপনে আগরবাতি জ্বালানো থেকে শুরু করে মশাল প্রজ্বালন একটি সাধারণ রীতি হয়ে গেছে। বিশেষ করে ইন্দোনেশিয়ায় ঈদ উপলক্ষে নারী-পুরুষনির্বিশেষে সবাই ঐতিহ্যবাহী মশাল শোভাযাত্রায় অংশ নেন। আর চীনে ঈদের নামাজ শেষে বিভিন্ন স্মরণীয় স্থানে আগরবাতি জ্বালানোর প্রচলন আছে।

বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তান ছাড়াও এ অঞ্চলের বেশ কিছু দেশে ঈদের আগের রাত থেকেই মেহেদি দিয়ে হাত সাজানো হয়। ছোট মেয়ে থেকে শুরু করে বয়স্ক নারীরাও এ উপলক্ষে মেহেদি দিয়ে হাত রাঙিয়ে নেন।

ইন্দোনেশিয়ায় এই ঈদে ত্যাগের মূর্ত প্রতীক হিসেবে বিভিন্ন রকমের সবজি ও ফলমূল দিয়ে বিশাল আকৃতির একটি জিনিস তৈরি করা হয়। একে বলা হয় ‘গুনুনগান’। ঈদের নামাজের পরপরই গুনুনগান থেকে সবাই সবজি ও ফলমূল খায়। বিশ্বাস করা হয়, পবিত্র ঈদুল আজহার দিনে গুনুনগান থেকে সবজি ও ফলমূল খেলে সারা বছর সুখ ও সমৃদ্ধিতে কাটে।
মধ্য এশিয়ার দেশ কাজাখস্তানে এই ঈদকে স্থানীয় ভাষায় ‘কুরবান আইত’ বলা হয়। ঈদ উপলক্ষে সেখানকার প্রধান প্রধান শহরে খেলাধুলার বিশেষ আয়োজন করা হয়। কাজাখ মুসলিমরা ঈদ উদ্যাপনের সময় একে অপরের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। তাঁরা অন্যদের মধ্যে ঐতিহ্যবাহী বাউরসাকি রুটি বিতরণ করেন। তবে ঈদতে তাঁরা খাসির মাংস, স্যুপ, চা, কিমিজসহ (ঘোড়ার দুধ) জনপ্রিয় খাবার ও পানীয় খান।
উজবেকিস্তানে এই ঈদকে স্থানীয় ভাষায় ‘কুরবান হাইত’ বলা হয়। এই দেশে কুরবান হাইতের আগের দিন থেকেই সব প্রস্তুতি শুরু হয়। হাইতের আগের দিনকে বলা হয় ‘আরাফা’। আরাফার দিনে প্রতিটি উজবেক পরিবার ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি তৈরি করে—যেমন কুশ-টিলি, বুগিরসোক, পেস্ট্রি বল, ওরামা ও চাক-চাক।

সন্ধ্যায় প্রতিটি পরিবার প্লোভ রান্না করে। উজবেক প্লোভ উজবেকিস্তানের একটি ঐতিহ্যবাহী এবং অত্যন্ত জনপ্রিয় খাবার। এটি উজবেকিস্তানের জাতীয় খাবার হিসেবে পরিচিত। উৎসবে এটি পুরুষেরা রান্না করেন। প্লোভ মূলত চাল, টুকরা মাংস (সাধারণত ভেড়া বা গরুর মাংস), কোচানো গাজর এবং পেঁয়াজ দিয়ে তৈরি করা হয়। এটি সাধারণত একটি বিশেষ পাত্রে (যাকে কাজান বলা হয়) রান্না করা হয়। প্লোভ কোসায় (বড় মাটির বাটি) করে পরিবেশন করা হয়। স্বাদে বৈচিত্র্য আনতে অনেক সময় এতে বিভিন্ন ফল, যেমন কিশমিশ বা বাদাম ও চিকপিস (চানার ডাল) যোগ করা হয়।
উজবেকিস্তানে কুরবান হাইত অন্যান্য দেশের মতো ঈদের নামাজ দিয়ে শুরু হয়। নামাজের পর কোরবানি করা হয়। উজবেকিস্তানে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভেড়া কোরবানি করা হয়। ঈদ উপলক্ষে মেলা বসে। মেলায় শিশুদের জন্য কাঠ ও টিনের খেলনা, টিনের বাঁশি এবং মাটির বাঁশি, বিভিন্ন আকারের চকলেট এবং মিষ্টির বড় বল ‘বোডিরোক’ বিক্রি করা হয়।

আফ্রিকা

আইভরি কোস্ট থেকে কেনিয়াসহ আফ্রিকার সব দেশেই উৎসবের মেজাজে পশু কোরবানি করা হয়। এসব দেশে ঈদের সময় ধনসম্পদের পাশাপাশি দানশীলতার কাজও প্রদর্শিত হয়। যেমন নাইজেরিয়ার কানোর আমিরকে স্বাগত জানানোর অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে দক্ষিণ আফ্রিকার একটি এনজিওর পক্ষ থেকে দরিদ্রদের জন্য খাবার তৈরি করা হয়।
আফ্রিকান দেশগুলোর মধ্যে মাদাগাস্কার একটি দ্বীপরাষ্ট্র। দেশটিতে মোট জনসংখ্যার মাত্র ৭ শতাংশ মুসলিম। তবু পবিত্র ঈদুল আজহা সব ঐতিহ্যবাহী রীতি মেনে সেখানে উদ্যাপিত হয়। পৃথিবীর অন্যান্য স্থানের মতো পবিত্র ঈদুল আজহার দিনে সূর্যোদয়ের পরেই তারা নতুন পোশাকে মসজিদে নামাজ পড়ার জন্য যান। নামাজের পর মানুষ রাস্তায় জড়ো হয়ে একে অপরকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান।

মাদাগাস্কারের অন্যতম প্রতীক হলো জেবু। এটি মাঝারি আকারের শিংযুক্ত এবং কুঁজযুক্ত গবাদিপশু, যার মাথা ও কান ছোট। মসৃণ ছোট ছোট লোম আছে। এটি সম্পদের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। পবিত্র ঈদুল আজহায় জেবু কোরবানি করা হয়। কোরবানির মাংস দরিদ্র ও মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে বিতরণ করা হয়।
উদ্যাপনের একটি বড় অংশ খাবার। মাদাগাস্কারের লোকেরা সাধারণ মালাগাসি খাবার রান্না করেন। এর মধ্যে মাংস ও সবজিমিশ্রিত ভাত ও ‘গডরোগড্রো’ নামের মিষ্টি খাবার তৈরি করা হয়। গডরোগড্রো একটি ঐতিহ্যবাহী কেক, যা সাধারণত চালের আটা, নারকেলের দুধ, চিনি, ভ্যানিলা, দারুচিনি, জয়ফল ও তেলের সংমিশ্রণে তৈরি হয়।

লাতিন আমেরিকা
পিউ রিসার্চ সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, লাতিন আমেরিকায় প্রায় ৬০ লাখ মুসলিম আছে। এসব দেশে পবিত্র ঈদুল আজহা উদ্যাপনে তেমন কোনো বিশেষ রীতি দেখা যায় না। তাঁরা সাধারণ ধর্মীয় রীতি পালন করে থাকেন। তাঁরা নামাজ, খাবার ও পরিবারের সঙ্গে সময় কাটিয়ে ঈদ উদ্যাপন করেন।
উত্তর আমেরিকা

পিউ রিসার্চ সেন্টারের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৪০ লাখ মুসলিম বসবাস করেন। আর ২০২২ সালে কানাডা সরকারের তথ্য বলছে, কানাডায় এই সংখ্যা ১৭ লাখের একটু বেশি। এ দুই দেশই অভিবাসী সম্প্রদায়ের আবাসস্থল, যাঁরা তাঁদের নিজ দেশ থেকে ঈদের ঐতিহ্য নিয়ে আসেন। বিভিন্ন অভিবাসী পরিবার তাদের ধর্মীয় ঐতিহ্যের পাশাপাশি নিজস্ব ঐতিহ্যে পবিত্র ঈদুল আজহা উদ্যাপন করে। ঈদের সকালে মসজিদগুলোয় বহুসংস্কৃতির মানুষের সমাবেশ হয়।
ইউরোপ

ইউরোপে মোট জনসংখ্যার ৪ দশমিক ৯ শতাংশ মুসলিম। তাঁদের অধিকাংশই শরণার্থী ও অভিবাসী। শরণার্থীদের অধিকাংশই আবার আফ্রিকা, এশিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের কিছু অংশ থেকে সহিংসতা বা নিপীড়নের শিকার হয়ে পালিয়ে আসা মানুষ। তাঁরা ধর্মীয় ঐতিহ্যের পাশাপাশি নিজ দেশের ঐতিহ্যে পবিত্র ঈদুল আজহা উদ্যাপন করেন।
অস্ট্রেলিয়া

২০২১ সালের সরকারি পরিসংখ্যান বলছে, অস্ট্রেলিয়ায় আট লাখের বেশি মানুষ মুসলিম, যাঁদের অনেকেই অভিবাসী সম্প্রদায়ের অংশ। পবিত্র ঈদুল আজহা উপলক্ষে সিডনিতে বিপণিবিতানগুলো আলোঝলমল করে সাজানো হয়। অনেকেই নতুন পোশাক কেনেন।
তথ্যসূত্র: রয়টার্স, এএফপি, বিবিসি, আল–জাজিরা।
আরও পড়ুন: