ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন! অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপসহীন দেশনেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার মৃত্যু হঠাৎ আমাকে আড়ষ্ট করে দেয়। ঠিক কী দিয়ে শুরু করবো তা আজ মাথা থেকে আসছেই না। একেবারে ছাত্রজীবন থেকে শুরু করলে লেখা বড় হয়ে যায়। আবার শুরু না করলেও লেখা অপূর্ণ রয়ে যায়। তাই রাজনীতি বোঝার বয়স থেকেই শুরু করি। আমি তখন পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র। দেখলাম স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলন। তখন গণমাধ্যম বলতে বাংলাদেশ টেলিভিশন ও রেডিও। দুটি প্রচার যন্ত্রই এরশাদের গুণকীর্তনে অধিকাংশ সময় ব্যয় করতো। আর বাদবাকি সময় এরশাদ আমলের তথাকথিত সুশাসনের পরিকল্পনামাফিক কল্পিত সংবাদ প্রচার করতো। আমরা কিছুটা নিরপেক্ষ সংবাদের প্রত্যাশায় সন্তোষ রেডিওতে বিবিসি’র সংবাদ শুনতাম। সংবাদ শোনা এবং এই সংবাদের বিষয়ে বড়দের কাছে বিশ্লেষণ শোনাই ছিলো মূলত একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ।
এরশাদ আমলে আ. লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না বলে ঘোষণা দিলেও শেখ হাসিনা চতুরামি করে মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে সেই পাতানো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলো। কিন্তু বেগম জিয়া অংশ নেননি। এই থেকে শুরু হলো বেগম খালেদা জিয়ার অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করার সুদৃঢ়তা। দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের বিষয়ে আপসহীনতা। গণতন্ত্রহীনতার বিরুদ্ধে আপসহীনতা। পক্ষান্তরে পাতানো নির্বাচনে অংশগ্রহণ, পরবর্তীতে আবার গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের নামে আ. লীগ যুগপথ আন্দোলনে অংশ নেয়। অবশ্য আ. লীগ, জামায়াত-সহ প্রায় সবকটি দল স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। আ. লীগের এমন ঠকরাজনীতির পরও মোটামুটি সকলের ধারণা ছিলো আ. লীগ ক্ষমতায় আসবে। কিন্তু নির্বাচনের পর ফলাফল বলে দিলো-বাংলাদেশের মানুষ শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে ভালোবাসেন। বেগম জিয়ার ব্যক্তিত্ব, আপসহীনতা ও সরল-রাজনীতিকে পছন্দ করেন। আ. লীগ তার ব্যাপক ধুর্তামির একটি শক্ত জবাব-ও পেয়ে গেলো। কিন্তু ভারতের ষঢ়যন্ত্র থেমে গেলো না। ভারতের লক্ষ্য ছিলো বাংলাদেশে আ. লীগকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা। সুতরাং প্রথমবার বিফল হলেও ‘র’ এর মাধ্যমে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ ও সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা করে ভারত এগোতে লাগলো। বাংলাদেশের রাজনীতিতে বরাবরই অপরিণামদর্শী রাজনৈতিক দল জামায়াত ‘র’ এর পরিকল্পনায় পা দিলো এবং বিএনপি’র বিরুদ্ধে আ. লীগের সাথে যুথবদ্ধ হয়ে আন্দোলনে নামলো। আ. লীগ ও জামায়াতের শক্তিশালী কর্মীবাহিনী নিয়ে নেকড়ের মতো বিএনপি’র উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে বিএনপি পরাজিত হলো। এই সময়ের একটা করুণ স্মৃতি মনে পড়ে। তখন আমি ক্লাস টেন-এর ছাত্র। স্থানীয় পত্রিকায় লিখি। বন্ধুরা জানতো। নির্বাচনের পর স্কুলে গেলাম। কয়েকজন আ. লীগের বন্ধু আমাকে দেখে কটাক্ষের হাসি হাসছে। আর আমি অসহায়ের মতো স্কুলের মাঠ দিয়ে হেঁটে হেঁটে স্কুলের বারান্দার দিকে যাচ্ছি। ক্লাস রুমের কাছাকাছি হতেই আমার একজন হিন্দু বন্ধু বলেছিল, ওরে কিছু ক’স না। ওর মা হেরে গেছে!
বাস্তবতা হলো সেদিন থেকেই ম্যাডামকে মায়ের মতই শ্রদ্ধা করে এসেছি। এরপর শুরু হলো ১৯৯১ থেকে ২০০১ সালের আ. লীগের দুঃশাসনকাল। এই সময়ে জামায়াত বুঝতে পারলো, বিএনপি’র বিরুদ্ধে আ. লীগের সাথে যুগপথ আন্দোলনে কী ভয়াবহ ফলাফল। আ. লীগ জামায়াতের ব্যাপরে কতোটা নৃশংস হতে পারে! ফলে বিএনপি’র সাথে জামায়াত আবারও জোটবদ্ধ হয়ে আ. লীগের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অবতীর্ণ হলো। ২০০১ সালের নির্বাচনে আ. লীগের চরম বিপর্যায় হলো বিএনপি জামায়াত জোটের কাছে। এই জোট মূলত ম্যাডাম খালেদা জিয়ার অনিন্দ্য নেতৃত্বের নিরাপোস বাস্তবতা। ম্যাডাম জিয়ার মন্ত্রী সভায় জামায়াতের দু’জন মন্ত্রীও স্থান পেলেন।
আবারও ‘র’ এর নজর পড়লো ম্যাডামের উপর এবং বিএনপি’র ভবিষ্যৎ কাণ্ডারী তারেক রহমানের প্রতি। ‘র’ নিয়ন্ত্রিত কিছু মিডিয়া ও এনজিও ম্যাডাম খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানকে দুর্নীতির প্রতীকে পরিণত করার হীণষঢ়যন্ত্রে লিপ্ত হলো। কারণ স্বাভাবিক নির্বাচনে আ. লীগ আর কখনো ক্ষমতায় আসতে পারবে না। এটি ভারত ও আ. লীগ বুঝতে পারলো। আ. লীগ শুরু করলো জ্বালাও পোড়াও এর রাজনীতি। মাসের পর মাস হরতাল দিয়ে জিম্মি করা হলো দেশকে। গান পাউডার দিয়ে শত শত মানুষ পুড়িয়ে মারলো। ‘র’ এর সূক্ষ্ম পরিকল্পনায় ‘একুশে আগস্ট’ গ্রেনেড হামলার নাটক সাজানো হলো। ৬৪ জেলায় মুর্খ-মুসলিম নামধারীদের ‘র’ এর ছত্রছায়ায় প্রশিক্ষণ দিয়ে একযোগে বোমা হামলা করা হলো। বিএনপি জামায়াতকে নিয়ে ‘র’ নিয়ন্ত্রিত কিছু গণমাধ্যম দিনের পর দিন অপপ্রচার চালাতে লাগলো। সাংবধানিক বিধিনিষেধকে অমান্য করে তত্বাবধায়ক সরকার মানি না বলে ধৃষ্টতা দেখালো আ. লীগ। এরপর ‘র’ এর এজেন্ট সেনা নায়ক মইন ইউ আহমেদ [লেন্দুপ দর্জির সমতূল্য] ক্ষমতা দখল করে, ভারতীয় দাস ফখর উদ্দীনকে প্রধান উপদেষ্টা করলো। ২০০৮ সালের এক সুদূরপ্রসারী ষঢ়যন্ত্রমূলক নির্বাচনে আ. লীগ ব্যাপকভাবে জয়ী হলো। এরপর শুরু হলো তথাকথিত যুদ্ধাপরাধ বিচারের নামে রাজনৈতিক হত্যা। জামায়াতকে ঘায়েল করে শুরু করলো ম্যাডাম জিয়ার উপর নিপীড়ন। ১৫ বছরের ফ্যাসিবাদি শাসনে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব কার্যত ভারতের কাছে জিম্মি হয়ে পড়ে। ‘র’ নিয়ন্ত্রিত আ. লীগ সরকার বাংলাদেশের মানুষের উপর বিশেষ করে মুসলমানদের সীমাহীন নিপীড়ন-নির্যাতন করে। সরকারের কোন অর্গানকে ‘র’ নির্ভর করতে আ. লীগ বাদ রাখেনি। ম্যাডাম জিয়া দেশে থেকেই আন্দোলন সংগ্রামের অনুপ্রেরণা হয়ই রইলেন।
বস্তুত তাঁর সংগ্রাম ও নেতৃত্ব গুণাবলি উচ্চারিত হলেই সময় থমকে যায়। বাংলাদেশপন্থীদের দেশপ্রেমের স্মৃতির ভাঁজ খুলে যায়। রাজপথের ধুলো, কারাগারের দেয়াল, মিছিলের স্লোগান, সবকিছু একসাথে ভেসে ওঠে ইথারে। বেগম খালেদা জিয়া তেমনই এক নাম। একটি রাজনৈতিক দলের চেয়ারপারসন নন শুধু, বাংলাদেশ বিরোধী রাজনৈতিক দল ও নেতাদের জন্য তিনি সংগ্রাম, অবিচলতা, কঠোরতার সুদীর্ঘ-রুদ্ধশ্বাস অধ্যায়ের প্রতীক। রাজনীতিতে তাঁর পথচলা ছিলো আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত। কিন্তু দেশপ্রেমে থেমে যাওয়া তাঁর অভিধানে ছিলো না কখনো। মহান স্বাধীনতার ঘোষক সৎ-রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৮১ সালে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হওয়ার পর দেশ যখন শোক ও অনিশ্চয়তায় আচ্ছন্ন, তখন এক শোকাহত স্ত্রী দেশের কথা ভেবেই ধীরে ধীরে রাজনীতির বাস্তবতায় পা রাখেন। অনেকেই হয়তো ভেবেছিলেন, তিনি কেবল আবেগী প্রতীক হয়ে থাকবেন। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তিনি প্রমাণ করেন, রাজনীতি তাঁর কাছে নিছক উত্তরাধিকার-ই নয়, বরং পবিত্র দায়িত্ব। তাই স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ছিলো তাঁর চির-আপসহীন অবস্থান। কারাবরণ, গৃহবন্দিত্ব, আন্দোলনের চাপ সবই ছলো তাঁর রাজনৈতিক জীবনের নিয়মিত অংশ। তিনি পিছু হটেননি। আপস করেননি। বরং বারবার ঘোষণা দিয়েছেন। গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে হলে মূল্য দিতেই হবে। তিনি বিশ্বাস করতেন, গণতন্ত্রের প্রশ্নে কোনো মধ্যপন্থা নেই। বার বার তাকে তাই কারাগারে যেতে হয়েছে। তিনি দেশের জন্য তা হাসিমুখে মেনে নিয়েছেন। তবে বিনা-অপরাধে কারন্তরীণ করার ইতিহাস কারাগারের দেয়ালে লেখা রবে চিরকাল। দেশকে ভালোবেসে হারিয়েছেন প্রাণাধিক প্রিয় পুত্র। হারিয়েছেন হাজার হাজার আত্মীয় পরিজন। স্বজন ও রাজনৈতিক সহকর্মীকে। পুত্র তারেক রহমানকে নির্বাসিত করা হয়েছে। এরপর ম্যাডামকে বিনা চিকিৎসায় দিনের পর দিন হাজিরা দিতে হয়েছে আদালতে। সামান্য আপস করলেই তিনি রাজকীয়ভাবে বিদেশ যেতে পারতেন। স্বাচ্ছন্দের সাথে জীবন কাটাতে পারতেন। কিন্তু বিদেশ পাঠানোর জবাবে তিনি বার বার বলেছেন, ‘এই দেশ, এই দেশের মানুষকে ছেড়ে আমি কোথাও যাবো না।’ পৃথিবীর কোন দেশে তাঁকে পাঠাতে পারেনি কেউ। কিন্তু অমোঘ মৃত্যু তাঁকে ডেকে নিয়ে গেলো চিরতরে। তিনি আর ফিরবেন না ধূলি ধরায়। তবে তিনি মানুষের মনে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন। তাঁর দেশপ্রেম ও সত্য প্রতিষ্ঠায় আপসহীনতা চির-অম্লান হয়ে থাকবে পৃথিবীর ইতিহাসে।
লেখক: কলামিস্ট ও রাজনীতি বিশ্লেষক।
আরও পড়ুন:








