শুক্রবার

১৯ ডিসেম্বর, ২০২৫ ৪ পৌষ, ১৪৩২

ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া শোধ-প্রতিশোধের খেলায় হাদি হত্যার বিচার

মেশকাত সাদিক

প্রকাশিত: ১৯ ডিসেম্বর, ২০২৫ ২১:০৮

শেয়ার

ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া শোধ-প্রতিশোধের খেলায় হাদি হত্যার বিচার
ফাইল ছবি

স্যার আইজাক নিউটনের গতিবিষয়ক তৃতীয় সূত্র দিয়েই শুরু করি। এই সূত্রটির সাংঘাতিক সামাজিক গুরুত্ব আছে। সূত্রটি এমন-‘প্রত্যেক ক্রিয়ার সমান ও বিপরীত প্রতিক্রিয়া আছে।’ এই সূত্রটি ইনকিলাব মঞ্চের সদ্য শহীদ ওসমান হাদি-সহ সকল গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সাথে জড়িত বীর-বিপ্লবীদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। ওসমান হাদি আধিপত্যবাদ ও ফ্যাসিবাদকে গ্রহণ করতে পারেননি। অথবা সামাজিক অন্যায়-অবিচার অনাচার ইত্যাদি সহ্য করতে পারেননি অথবা স্বভাবগত প্রতিরোধ ও প্রতিবাদ-স্পৃহা থেকে তিনি সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংগ্রাম করেছেন। তিনি বার বার তাঁর বক্তব্যে বলতেন, তিনি আধিপত্যবাদের কবর রচনা করে একটি ইনসাফভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের স্বপ্ন দেখেন। তাঁর এই সমস্ত দ্রোহাত্মক বক্তব্যে আধিপত্যবাদী ও তাদের গোলামদের স্বার্থে আঘাত লাগে। যার ফলে প্রশিক্ষিত সন্ত্রাসী দিয়েই তাঁকে শ্যুট করে হত্যা করে। এটি স্পষ্টত-ই পতিত ফ্যাসিবাদি সন্ত্রাসী দ্বারা সংঘঠিত। এই হত্যাকাণ্ড ছিলো নিউটনের সূত্র অনুযায়ী ক্রিয়া (action)। এরপর দেশে যে অরাজকতা সৃষ্টি হয় এটি হাদির প্রতি সাধারণ মানুষের একান্ত ভালোবাসার প্রকাশ। এটি সন্দেহাতীতভাবে প্রতিক্রিয়া (reaction)। এই সূত্রের কিয়া-প্রতিক্রিয়াকে সামাজিক ব্যাখ্যার উপযোগী করে তোলার জন্য বলা যায়, শোধ-প্রতিশোধ। সাধারণভাবে হাদিকে হত্যা করে ক্ষমতাচ্যুত পলাতক হওয়ার মনোযন্ত্রণার মারাত্মক শোধ নিলো। হাদি-প্রেমিকেরা প্রতিশোধ কি তাঁদের উপর নিতে পারলো? বরং ৩য় পক্ষ ও রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোর উপর হামলা হলো। কিন্তু রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো বা গণমাধ্যমের উপর হামলা করে সংগ্রামী মানুষেরা কী ইনসাফ কায়েম করতে চায় তা রীতিমত গবেষণার দাবি রাখে।

তাই এই ভৌত সূত্রকে সমাজবাস্তবতায় প্রয়োগ করলে পাওয়া যায় এক গভীর সামাজিক দর্শন। রাষ্ট্র যখন বিপ্লবীদের উপর দমন-পীড়ন চালায়, মতপ্রকাশ রুদ্ধ করতে চায়, বিকল্প মাধ্যম তৈরি হয়, গোপন নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠে, গুজব ও চরমপন্থা বিস্তার লাভ করে, বিচারহীণতা ও অন্যায়কে স্বাভাবিক করে তোলে, তখন তা একমুখী থাকে না। সীমাহীন ত্যাগ ও চাওয়া-পাওয়ার মিল না হলেই সাধারণ জনতা জন্ম দেয় প্রতিবাদ। সেই প্রতিবাদ কখনো নীরব, কখনো বিস্ফোরক। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাস্তবতায় এটি দীর্ঘ অন্যায়ের প্রতিক্রিয়া। অভ্যুত্থানের পর পুরোনো অন্যায় নতুন নামে ফিরে আসে, জনআকাঙ্ক্ষা উপেক্ষিত হয়। আবার নতুন প্রতিক্রিয়া জন্ম নেয়। ইতিহাস বলে- প্রতিক্রিয়া কখনো শেষ হয় না, যদি ক্রিয়া বদলানো না হয়। তাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে বিশৃঙ্খলার দায় কার? এই প্রশ্নের একক, সহজ উত্তর নেই। এটি বহুস্তরীয় বাস্তবতার ফল। যেখানে ক্ষমতার শূন্যতা, রাজনৈতিক সংস্কৃতির সংকট, প্রাতিষ্ঠানিক দুর্বলতা এবং ফ্যাসিবাদের দোসর বাইরের রাষ্ট্রের ভয়াবহ প্রভাব। এসবকিছু একে অন্যকে ত্বরান্বিত করেছে। এছাড়াও গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী নেতৃত্বের পরিকল্পনাহীনতা, রাজনৈতিক দলগুলোর অসহনশীল ক্ষমতাচর্চা, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের দুর্বলতা, সুযোগসন্ধানীদের সহিংসতা, নাগরিক সমাজের নীরবতা এবং অপরাধ-অপরাধী দমনে সীমাহীন উদাসীনতা ও নির্লিপ্ততা বর্তমান সংকটের অন্যতম কারণ।

গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী গঠিত সরকারের অদক্ষতা

যে-কোন রাষ্ট্রে গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সরকার প্রবল শক্তিশালী ও প্রদক্ষ হতে হয়। কিন্তু আমাদের ক্ষেত্রে দেখা গেলো বিপরীত চিত্র। বর্তমান যারা কর্ম-অক্ষম ও অতীতেও যাদের রাষ্ট্র পরিচালনার ন্যূনতম কোন অভিজ্ঞতা নেই তাদেরকে নিয়েই গঠিত হলো ইন্টেরিম সরকার। কেউ কেউ এই সরকারকে এনজিও সরকার আবার কেউ কেউ এটিকে চট্টগ্রাম বিভাগীয় সরকার হিসেবে মূল্যায়ন করে। এতো রক্ত বিসর্জন ও শহীদের বিনিময়ে গোলামীর জিঞ্জির ভেঙে যে সরকার গঠিত হলো তা মূলত অযোগ্য-অদক্ষ ও প্রবীণ পুনর্বাসন কেন্দ্রে পরিণত হলো। সুতরাং ন্যায় বিচার বা দক্ষতা-নির্ভর প্রশাসন গড়ে তোলার যে আকাঙ্ক্ষা তা এদের দিয়ে পূরণ সম্ভব হলো না। আইনশৃঙ্খলা ব্যবস্থার সীমাহীন অবনতির ফলে দেশে অব্যাহত হত্যা-লুণ্ঠন রাহাজানি, চুরি-ছিনতাই, ডাকাতি প্রকাশ্যে অস্ত্রের ঝনঝনানি গত ১ বছরে এতটাই বৃদ্ধি পেয়েছে, তা বাংলাদেশ আর কখনো দেখেছে কি না সে-বিষয়টি সন্দেহের অবকাশ রাখে। এরপরও দায় ঘাড়ে নিয়ে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা পদত্যাগ করলেন না। তার ক্ষেত্রে বিষয়টি এমন হয়েছে যে, জোরেও হাঁটবে না। আবার পথও ছাড়বে না। এমন হলে রাষ্ট্র চলে না। ওসমান হাদীর হত্যার সাথে জড়িত খুনি নির্বিঘ্নে দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে গেলো। প্রাথমিক ও প্রত্যক্ষভাবে এই দায় তো মোদির নয়। এই দায় তো হাসিনার-ও নয়। এই দায় তো নিশ্চিতভাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার। এরপর সারাদেশব্যাপী যে প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হলো এবং ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ড হলো এর দায় কি শুধুই সাধারণ ছাত্র-জনতার?

গণমাধ্যম আক্রান্ত কেন

প্রতিবার নোবেল প্রাইজ ঘোষিত হলেই একটি আলোচনা হয়। মাঝে মাঝে তা বিতর্কে রূপ নেয়। কেন মুসলমান বিজ্ঞানী, লেখক বা শান্তিকামীকে যথাযথ মূল্যায়ন করে গাদা গাদা নোবেল প্রাইজ দেয় না? এসব শুনে আমি বিস্মিত হই!! কারণ নোবেল প্রাইজ যারা চালু করেছে বা যারা এটি প্রদানের কমিটিতে থাকে তারা মুসলমানদের কেন দেবে? তারা কি মুসলমান? মুসলমানরা এর বিকল্প তৈরি করে না কেনো? ইহুদি খ্রিষ্টানের চেয়ে কি মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক দেশগুলির অর্থ-সম্পদ কম? কখনও কম নয়। কিন্তু এটি তারা করবে না। তারা চরম ভোগ বিলাসে মত্ত। ঠিক তদ্রূপ আমাদের দেশেও কিছু কিছু গণমাধ্যম আছে যারা সাম্যবাদের, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চায়। তাদেরকে জোর করে বিএনপি-জামায়াত বা এনসিপি-ইনকিলাব মঞ্চের পক্ষে বয়ান সৃষ্টি করতে বললে তারা কেন করবে? তারা তো একই আদর্শ লালন করে না। এখন তাদেরকে বাধ্য করতে যাওয়া বা বিনাশ করতে যাওয়ার মধ্যে কোন গণতন্ত্র বা দূরদর্শীতা নেই। যাদেরকে বিনাশ করতে চাওয়া হলো তাদের পত্রিকার প্রত্যেকটি সেক্টরের সাথে অন্যান্য পত্রিকার সমসেক্টরের তূলনা করে দেখেন, বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চায় তারা কতোটা এগিয়ে! তাদের সমকক্ষতা অর্জন করতে পারলেই অথবা যথারূপ বিকল্প গড়ে তুলতে পারলেই তাদেরকে মানুষ এমনিতেই বয়কট করবে। সারভাইবাল ফর দ্যা ফিটেস্ট নীতি অনুসরণ করা প্রয়োজন। তা না হলে অন্যরা দেশপ্রেমিক শক্তির ক্বলিজা ছিড়ে খাবে। আর দেশপ্রেমিকেরা চেয়ার টেবিল পোড়ানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।

শোধ-প্রতিশোধ এই অশান্তির জনক

পলাতক ফ্যাসিস্ট হাসিনা টেলিফোনে তার গ্যাং বাহিনীকে এদেশের স্বাধীনতা-পন্থীদের হত্যার উসকানি দেয়। তার কিছুদিন পরেই হাদিকে গুলি করে আ. লী সন্ত্রাসী ফয়সাল করিম। এখন বাংলাদেশে এর প্রতিশোধ চলছে। কিছুদিন প্রতিশোধের খেলা চলে বন্ধ হবে। কারণ আমরা মারাত্মক ভুলোমন জাতি। এই আবেগ বেশি দিন থাকবে না। তখন যে আবারও আরেকজন হত্যা হবে না তার নিশ্চয়তা কোথায়? এই শোধ-প্রতিশোধের খেলা বন্ধ করতে হলে পলাতক হাসিনা ও তার সন্ত্রাসী বাহিনী, হাদির হত্যাকারীকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার জন্য বিশ্বজনমত গড়ে তোলা দরকার। না হলে এই শোধ-প্রতিশোধের খেলা বন্ধ হবে না।

হাদির হত্যাকাণ্ড কোনো বিচ্ছিন্ন অপরাধ নয়। এটি সমাজের নিরাপত্তা, রাষ্ট্রের ন্যায়বোধ এবং প্রশাসনের জবাবদিহির উপর সরাসরি আঘাত। মানুষ বিচার চায়। এটি প্রতিশোধ নয়। ন্যায় চায়। সুবিচার চায়। মানুষের মনে বড় প্রশ্ন ‘এই দেশে জীবন কি এখনো আইনের সুরক্ষায় আছে, নাকি কোন বহিঃশক্তির কাছে জিম্মি?’ ন্যায়বিচার বিলম্বিত হলে তা সমাধিস্থ হওয়ার নামান্তর। তদন্তের নামে সময়ক্ষেপণ, দায় এড়ানোর কৌশল, কিংবা রাজনৈতিক প্রভাব, সবই মানুষের আস্থা ভেঙে দেয়। হাদি হত্যার সুষ্ঠু বিচার মানে শুধু খুনির শাস্তি নয়। আজ যে মানুষ রাস্তায়, সামাজিক মাধ্যমে, পত্রিকা কলামে এক কণ্ঠে বিচার চাইছে এর মাধ্যমে তারা রাষ্ট্রকে মনে করিয়ে দিচ্ছে: ন্যায়বিচার কোনো দয়া নয়, এটি প্রতিটি নাগরিকের অধিকার। হাদির রক্ত যেন আরেকটি পরিসংখ্যান হয়ে না যায়। হাদির নাম যেন আরেকটি ফাইল হয়ে ধুলা না খায়। মনে রাখতে হবে অন্তবর্তী সরকারের পরীক্ষা এখন একটাই। হাদি হত্যার ন্যায় বিচার। মনে রাখতে হবে কোটি কোটি মানুষ সরকারের যথাযথ পদক্ষেপের দিকে তাকিয়ে আছে। তাকিয়ে আছে বাংলাদেশের ইতিহাসও।

লেখক: কলামিস্ট ও রাজনীতি বিশ্লেষক (মেশকাত সাদিক)



banner close
banner close