শনিবার

১৩ ডিসেম্বর, ২০২৫ ২৯ অগ্রহায়ণ, ১৪৩২

বঙ্গবীর হাদির উপর প্রাণ-ঘাতী হামলা: জামায়াত আমীরের দুঃখজনক মন্তব্য

মেশকাত সাদিক

প্রকাশিত: ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৫ ১১:০৫

শেয়ার

বঙ্গবীর হাদির উপর প্রাণ-ঘাতী হামলা: জামায়াত আমীরের দুঃখজনক মন্তব্য
ছবি: কোলাজ বাংলা এডিশন

গতকাল ১২ ডিসেম্বর ২০২৫ খ্রি: তারিখ দুপুর ২ টা ৩৫ মিনিটে ইনকিলাব মঞ্চের আহ্বায়ক বঙ্গবীর হাদির খুব কাছ থেকে মাথায় গুলি করেছে প্রশিক্ষিত কিলার। কিলার আগে থেকেই তার সাথে ঢাকা-৮ আসনের সংসদ নির্বাচনী প্রচারণায় অংশ নেয়। এরপর জুম্মার নামাজের পর বঙ্গবীর হাদির অটোরিকশাকে অনুসরণ করে মোটরসাইকেলের পেছনে বসা সন্ত্রাসী। বিজয়নগরের কালভার্ট নামক স্থানে বঙ্গবীর হাদির মাথার ডানপাশে নিচের দিকে গুলি করে পালিয়ে যায়। তৎক্ষণাৎ হাদি লুটিয়ে পড়লে দ্রুত ঢাকা মেডিকেলে নিলে তাকে লাইফ সাপোর্ট দিয়ে কোমায় রাখা হয়। এরপর সার্জারি করে পরিবারের চাহিদা মোতাবেক বেসরকারি হাসপাতাল এভার কেয়ারে প্রেরণ করা হয়েছে। এই স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের অতন্ত্র প্রহরী দেশপ্রেমিক সূর্য সন্তানকে সেখানেও লাইফ-সাপোর্টে রাখা হয়েছে। সংক্ষিপ্তভাবে এই হলো ঘটনা। এরপর সারাদেশে প্রতিবাদ, প্রতিরোধ ও আইনশৃঙ্খলার দায়িত্বে থাকাদের নিয়ে ব্যাপক সমালোচনা চলছে। এই হত্যা চেষ্টার সাথে জড়িত কেউ গ্রেফতার হয়নি। এটি দেশেীয় চক্রান্ত না কি পলাতক ফ্যাসিস্টের সুপরিকল্পিত আক্রমণ? তা-ও এখনো নিশ্চিত হওয় যায়নি। তদুপরি আগাম মন্তব্য অনেক সময় ঘটনাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করতে পারে বিধায় সরাসরি মন্তব্য না করাও যুক্তিযুক্ত। কিন্তু বঙ্গবীর হাদিকে গুলি করার পরের বিষয়াদি অতিশয় দুঃখজনক। কিছু রাজনৈতিক নেতৃত্ব এরই মধ্যে রাজনৈতিক প্রকতপক্ষের দিকে সন্দেহের তীর ছুঁড়ে দিয়েছেন, যা দায়িত্বশীল জায়গা থেকে কাম্য নয়। কিন্তু নির্বাচনী তফসিল ঘোষণার পরও সুপরিচিত, প্রখ্যাত একজন রাজনীতিককে এভাবে গুলি করা হলো, এর জন্য দায় কার? চলুন সেটি একটু বিশ্লেষণ করে আসা যাক-

দায় কার? ইন্টেরিম সরকার না নির্বাচন কমিশনের?

অনেকে বলবেন তফসিল ঘোষণার পর সব-দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের উপর বর্তায়। খাতা-কলমের আইন অনুযায়ী অবশ্যই তাই। কারণ এখন রাষ্ট্রের কোন কর্মকর্তা-কর্মচারী কোথাও বদলি বা পদায়ন করতে হলেও তা নির্বাচন কমিশনের সাথে আলাপ করেই করতে হবে। অথবা নির্বাচন কমিশন চাইলে যে-কোন পদ-পদবির কর্মকর্তাকে বদলি করতে পারবে। সেক্ষেত্রে নির্বাচন কমিশন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট লিখলে তা বাস্তবায়নের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তফসিল ঘোষণার সাথে সাথে নির্বাচন কমিশনকে সংবিধান যে ক্ষমতা দিয়েছে তার এক ছিটে ফোটাও তারা এখনও বাস্তবায়ন শুরু করেনি। অর্থাৎ তফসিল ঘোষণার সাথে সাথে যে মার মার কাট কাট করে একটি ধুন্ধুমার অবস্থা সৃষ্টি করবে তা করেনি। কারণ দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও দুঃসাহসিকতার চরম ঘাটতি। ফ্যাসিবাদিরা ৫-১০ বছর পর ফিরে এলে কি হবে? সেই ভয়েই এখনও অনেকেই তটস্থ। যারা একেবারেই তটস্থ নয়, তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন বঙ্গবীর হাদি। যে-কারণে তার উপর এই জীবননাশী আক্রমণ।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা কোথায়?

গতকালের ঘটনার পর থেকে আড়ষ্ট জিহ্বার স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা নিখোঁজ। চরম অদক্ষ অপদার্থ ও ভারতের সেবাদাস এই স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা এখনও পদত্যাগ করেনি, এর থেকে বোঝা যায় যে, সামনে রাজনীতিবিদদের উপর এ রকম আরও আক্রমণ হতে পারে। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্বকে একে একে হত্যার মিশন ‘র’ ও তাদের এদেশীয় চর আ. লীগ এবং আ. লীগ সমর্থিত এই ধরনের মিনমিনে রাষ্ট্র পরিচালকদের আছে। দেশের আইনশৃঙ্খলাকে পরিকল্পিতভাবে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য প্রথমে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বানানো হয়, ব্রি. সাখাওয়াতকে। সচেতন নাগরিক মাত্রই জানেন যে, ১/১১ পর থেকে তিনি নির্বাচন কমিশনের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে থেকে কিভাবে ‘র’ এর সাথে হাত মিলিয়ে বিএনপি’কে ভেঙে টুকরো টুকরো করতে চেয়েছিলেন। যদি ভুলে যান তাহলে সেই সময়কার ভিডিও ও তার বক্তব্য যদি ইউটিউবে থেকে থাকে তাহলে দেখে আসতে পারেন। তার বিষয়ে বিএনপি’র তরফ থেকে অভিযোগ এলে তাকে সরিয়ে লে. জে. জাহাঙ্গীরকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ন্যাস্ত করে সরকার। কিন্তু তিনিও যে, ‘র’ এর প্রোডাক্ট তা বোঝা গেলো, যখন বিডিআর বিদ্রোহের স্বাধীন তদন্ত কমিশন তাকে অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করলো, তখন। বাংলাদেশের মানুষ মনে করেছিল এই চিহ্নিত অপরাধীকে সরকার গ্রেফতার দেখাবে অথবা ন্যূনতম দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেবে। কিন্তু কিছুই হলো না। এমন ভারতীয় চর দিয়ে শান্তি শৃংখলাপূর্ণ পরিবেশ সম্ভব হবে না। বিএনপি মনে করছে বামদের কাছে টেনে ভারতের কোলে বসে এই দেশ চালাবে? তা নাও হতে পারে। আবার জামায়াত মনে করছে আ. লীগকে বিভিন্নভাবে নির্যাতন ও তাদের ব্যবসা বাণিজ্য দখল করেছে বিএনপি, অতএব আ.লীগ তাদের ভোট দেবে, সেই ভোটে তারা ক্ষমতায় আসবে। জামায়াতের এই যে অর্বাচীন চিন্তা তা সফলতার মুখ দেখার সম্ভাবনা নেই। কারণ শেষ মুহূর্তে যদি নির্বাচন হয়, তাহলে দিল্লীদাসি দিল্লী থেকেই আ. লীগকে ভোট বয়কট করতে বলবে। তাতে প্রায় ১৫ শতাংশ নিশ্চিত ভোট কাস্টিং কম হবে। অর্থাৎ যদি ৫০ শতাংশ ভোট কাস্ট সম্ভাবনা থেকে থাকে তাহলে তা ৩৫ শতাংশে এসে দাঁড়াবে। তখন সেই নির্বাচন যতই সুষ্ঠু হোক তা কি সর্বগ্রাহ্যভাবে গ্রহণযোগ্যতা পাবে?

জামায়াত আমীরের দায়িত্বহীন মন্তব্য

এর পূর্বেও অনেকবার জামায়াত আমীর ‘ছেলে-ছোকড়া’র মতো মন্তব্য করে সমালোচনার পাত্র হয়েছেন। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না। জামায়াত নিয়ন্ত্রিত একটি পত্রিকার সংবাদ- ‘নির্বাচনী গণসংযোগকালে গুলিবিদ্ধ হয়েছেন ঢাকা-৮ আসনের সম্ভাব্য স্বতন্ত্র প্রার্থী ও ইনকিলাব মঞ্চের মুখপাত্র শরিফ ওসমান হাদি। এই ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা: শফিকুর রহমান। তিনি বলেছেন, কোনো রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা মতভিন্নতার কারণে এ ধরনের সহিংসতা কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়। শুক্রবার ওসমান হাদি গুলিবিদ্ধ হওয়ার পরপরই নিজের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে দেয়া একটি পোস্টে জামায়াত আমির একথা বলেন।’

চলুন তার মন্তব্য একটু বিশ্লেষণ করি, জামায়াত আমির বলেছেন, ‘কোনো রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা বা মতভিন্নতার কারণে এ ধরনের সহিংসতা কখনোই গ্রহণযোগ্য নয়।’ এখানে যদি তিনি শুধু ‘মতভিন্নতার কারণে’ উল্লেখ করতেন তাহলে সেটি ব্যাপক পরিসর বোঝাত। এবং দেশী-বিদেশী চক্রান্তে বঙ্গবীর হাদি মৃত্যুর মুখোমুখি- এমনটাও বোঝাত। কিন্তু তিনি তা না বলে সাথে যোগ করে দিলেন, ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতা’ শব্দটি। এতে সুনির্দষ্ট করে দেওয়া হলো যে, এটি তার প্রতিদন্দ্বী মীর্জা আব্বাস সাহেবের কাজ। এ ধরনের বালখিল্য মন্তব্য জাগতিক আইন ও পরকালীন বিধান কোনটির মধ্যেই পড়ে না। কারণ যদি মীর্জা আব্বাস এই ঘটনার সাথে জড়িত না থাকেন। তাহলে মূল আসামী অপরাধ করা সত্ত্বেও পার পেয়ে যেতে পারেন। এটি চলমান রাজনীতিতে মারাত্মক প্রভাব ফেলবে। পক্ষান্তরে মির্জা আব্বাস অপরাধী না হলে নিরাপরাধীকে অপরাধী হিসেবে প্রোমোট করাও তো জুলুম। এছাড়া এমন যদি হয় যে, এই কিলার ছাত্রলীগ করে এবং ভারতে পলাতক তাদের নেতাদের নির্দশে এটা করেছে। তাহলে জামায়াত আমীর কী করবেন? ক্ষমা চাইবেন? বার বার ভুল বড় নেতার মানায় না। জামায়াত আমীর এতো বড় দলের প্রধান হওয়ার যোগ্যতা রাখেন কি না তা জামায়াতকেই ভাবতে হবে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি বিষয় বার বার ভেসে আসে। সেটির মূল বক্তব্য এই রূপ- পলাতক হাসিনাকে যখন নানক-কামালরা বলেছে যে, ‘আপনাকে যারা ফাঁসি দিয়েছে তাদের এক এক করে সবাইকে দেখে নেবো। তখন ফ্যাসিস্ট হাসিনা তো বলেছেই, এসব আশ্বাস বাদ দিয়ে লাশ ফেলেই দেখাও।’ এরপরও বিএনপি-জামায়াত মনে করে আ.লীগকে পুনর্বাসন করবে। ভারতের আনুকূল্যে ক্ষমতায় এসে দেশ চালাবে। সে-গুড়ে বালি। মনে রাখতে হবে ভারত বাংলাদেশের চোখের বালি। ভারত কখনো যদি আ. লীগকে বাংলাদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় আনতে পারে, তাহলে বিএনপি-জামায়াতের অস্তিত্ব রাখবে না।

অতএব. বিএনপি-জামায়াত দায়্বিহীন মন্তব্য থেকে বিরত হন। নিজেদের মধ্যে কাদা ছুড়াছুড়ি বাদ দিয়ে দেশে সত্যিকার বাংলাদেশভিত্তিক রাজনীতি চালু করুন। ভারত আমাদের কখন-ই বিশ্বাস করবে না। বন্ধু হবে না। কারণ যারা গরুর পেছনে দাঁড়িয়ে থাকে কখন মুতবে আর সেটি খেয়ে অমরত্ব পাবে এবং স্বর্গলাভ করবে। তাদের মতো জাহেল কখনও মুসলমানদের বিশ্বাস করবে না। সুযোগ পেলেই আমাদের মারাত্মক ক্ষতি করবে। পারলে আক্রমণ করবে। তাই সমরাস্ত্রে সমৃদ্ধ হয়ে ১৮ কোটি মানুষকে সেনা-প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন। এতে ভারত ভয় পাবে এবং একটি সম্মানজনক বন্ধুত্বের সম্পর্ক সৃষ্টি হবে। মনে রাখতে হবে, কাজীর দরবারে উপস্থিত হয়ে সামাজিক রীতিনীতি মনে বিবাহের পরে ঘরে পরকিয়ার বিষ ঢুকলে যেমন খাতা-কলমে একজনের সাথে সম্পর্ক থাকে, কিন্তু প্রকৃত সম্পর্ক অন্যজনের সাথে হয় এবং চূড়ান্ত সময়ে খাতা-কলমের স্বামী বা স্ত্রীকে হত্যা করে পরকীয়ার সাথে সংসার পাতে, তেমনি আ.লীগ-ও আইনগতভাবে বাংলাদেশের হলেও ভারতের সাথে পরকীয়ায় লিপ্ত। অতএব বাংলাদেশের সামনে ভয়াবহ সময় অপেক্ষমান।

লেখক: কলামিস্ট ও রাজনীতি বিশ্লেষক



banner close
banner close