বৃহস্পতিবার

৪ ডিসেম্বর, ২০২৫ ১৯ অগ্রহায়ণ, ১৪৩২

ভারতে মুসলিম নিপীড়নের বীজ বুনেছিলো ব্রিটিশদের তৈরি মিথ্যা ইতিহাস

আশিকুল মাওলা আদর

প্রকাশিত: ৪ ডিসেম্বর, ২০২৫ ০২:১৬

আপডেট: ৪ ডিসেম্বর, ২০২৫ ০২:১৮

শেয়ার

ভারতে মুসলিম নিপীড়নের বীজ বুনেছিলো ব্রিটিশদের তৈরি মিথ্যা ইতিহাস
ছবি: বাংলা এডিশন

ভারতে, মানে ভারতীয় উপমহাদেশে যে চিরকালীন হিন্দু-মুসলিম দ্বন্দ্ব তা যে ব্রিটিশদের "ডিভাইড অ্যান্ড রুল" থিওরির ফল তা নিয়ে ইতিহাসবিদ থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ প্রায় সবাই নিঃসন্দেহ। তবে এর মানেই এই নয় যে, ব্রিটিশরা বলছে- তোমরা আলাদা হয়ে যাও আর সঙ্গে সঙ্গেই তারা আলাদা হয়ে গেছে।

বর্তমানে আমরা যে বিশ্ব ইতিহাস পড়ি বা জানি তা মূলত "ইউরোপীয়" মাপকাঠিতে তৈরি করা- প্রাচীন যুগ, মধ্যযুগ ও আধুনিক যুগ।

১৮১৭ সালে প্রকাশিত হয় স্কটিশ ইতিহাসবিদ, অর্থনীতিবিদ, রাজনৈতিক মতের প্রবক্তা ও দার্শনিক জেমস মিল এর বই "দ্য হিস্ট্রি অব ব্রিটিশ ইন্ডিয়া"। উইকিপিডিয়ার তথ্য বলছে, তিনিই প্রথম ইতিহাসবিদ যার বইয়ে ইতিহাসকে " কলোনিয়াল অ্যাপ্রোচে" তুলে ধরা হয়েছিল হিন্দু, মুসলিম এবং ব্রিটিশ- এই তিন ভাগে।

এই কথা নিজ বইতে উল্লেখ করেছেন ইউনিভার্সিটি অব অ্যারিজোনার ইতিহাসের অধ্যাপক রিচার্ড ম্যাক্সওয়েল ইটন সাহেবও। তিনি তার "ইন্ডিয়া ইন দ্য পারশিয়ানেট এজ ১০০০-১৭৬৫" বইতে লিখেছেন, জেমস মিলের বইয়ে ইতিহাসকে হিন্দু, মোহামেদান এবং ব্রিটিশ পর্বে ভাগ করে লিখার বিষয়টি। এখানে ইতিহাসের হিন্দু থেকে মোহামেদান পর্বে উত্তরণকে দেখিয়েছেন "প্রাথমিক হিন্দুদের অধীনের স্বর্ণযুগ থেকে মোহামেদান বা মুসলিম স্বৈরশাসন বা প্রজাদের দমন-পীড়নের আমলে প্রবেশ" হিসেবে।

রিচার্ড এম ইটন বলছেন, ভারতের ব্রিটিশ শাসকদের বর্ণনায় এই পরিবর্তন ছিল গ্রেকো-রোমান সময়ের জাঁকজমকপূর্ণ শাসনামল থেকে ইউরোপের মধ্যযুগে "পতনের" মতো। ব্রিটিশ ইতিহাসবিদরা তাদের ইতিহাসের বর্ণনায় ভারতীয় উপমহাদেশে আগত তুর্কিদেরও দেখিয়েছেন অনাকাঙ্ক্ষিত, অনাহূত আগন্তুক হিসেবে যাদের হাত থেকে এ অঞ্চলের মানুষকে "উদ্ধার" করেছে ব্রিটিশরা!!! যার ফলেই নাকি শুরু হয়েছে এ অঞ্চলের আধুনিক যুগের...!

দ্বাদশ শতকের বেশিরভাগ সময় ধরেই খোরাসান এবং আফগানিস্তানে সেলজুক ও গজনভিদের শাসন চললেও পরবর্তীতে গজনভিদের ক্রমাগত অধঃপতনের কারণে সেখানে এবং পাঞ্জাবে 'পাওয়ার ভ্যাকিউম' তৈরি হয়। দ্রুত এ শূন্যস্থান পূরণ করতে এগিয়ে আসে আফগানিস্তানের হিন্দুকুশ পর্বতমালার মধ্য থেকে উঠে আসা ঘুরি-রা। দ্বাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় থেকে শুরু করে তারা পরবর্তীতে দ্রুতই গজনভিদের সাম্রাজ্য দখলে নেয়, যার ফলে পরে ধীরে ধীরে দিল্লি সালতানাত (১২০৬-১৫২৬) প্রতিষ্ঠার পথ প্রশস্ত হয়।

১১৪৮-এ গজনি দখলের পর ১১৭৫ সালে পশ্চিমে সেলজুকদের থেকে তারা দখল করে নেয় গুরুত্বপূর্ণ হেরাত শহর।১২০১ সালে তাদের দখলে আসে মার্ভ, তুশ ও নিশাপুর। ঘুরিদের এ সাম্রাজ্য বিস্তারের সময় তাদের এ অভিযানের নেতৃত্বে ছিলেন দুই আপন ভাই। তাদের মধ্যে যিরি ছোট ভাই ছিলেন, শিহাব আল দিন বিন শাম, যাকে আমরা মোহাম্মদ ঘুরি নামেই বেশি চিনি। ধীরে ধীরে তার বাহিনী উত্তর ভারতের বেশিরভাগ শহরই দখল করে- মিরাট, উজ্জৈন, দিল্লি, কোল (আধুনিক আলিগড়), বেনারাস, আজমির, কনৌজ, গোয়ালিয়র ইত্যাদি।

পার্সিয়ান ঘরানার ইসলামি ধর্মবিশ্বাস থেকে উঠে আসা এই ঘুরিরা পরবর্তীতে ১১৯৯ সালে সুন্নি ইসলামেও দীক্ষিত হন।

তাদের সমসাময়িককালের কোনো দলিল-দস্তাবেজ, মুদ্রা কিংবা দেয়ালচিত্রের কোথাওই ঘুরিরা বলেননি যে, তাদের ভারত বা উত্তর ভারতব্যাপী এ ব্যাপক অভিযান তারা ইসলামের পবিত্র যুদ্ধ বা গাজা বা 'গাজাতুল হিন্দের' দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে করেছেন। এমনকি ভারতে তাদের যে অভিযানের শুরু তাও কিন্তু কোনো হিন্দু, বৌদ্ধ বা অন্য ধর্মপ্রধান রাজ্যের বিরুদ্ধে নয়। তাদের প্রথম আক্রমণগুলো ছিল মুলতানে ইসমাইলি এবং লাহোরে গজনভিদের ওপর, যে দুটিই ছিল মুসলিম সাম্রাজ্য বা মুসলিম ধর্মপ্রধান সাম্রাজ্য। অথচ, ব্রিটিশ কলোনিয়াল লেখকরা উত্তর ভারতে ঘুরিদের এসব অভিযানকে ইসলামিক পবিত্র যুদ্ধ বা 'গাজা' দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে করা বলে উল্লেখ করেছেন।

পাঠকদের প্রতি আবারও প্রশ্ন- তাহলে এই যে ব্রিটিশদের দ্বারা লিখিত ও এখন পর্যন্ত প্রচলিত ইতিহাসে যে হিন্দুশাসিত প্রচীন স্বর্ণযুগ, এরপর মুসলিমশাসিত 'বর্বর' মধ্যযুগ এবং এ থেকে উদ্ধারে শেষে ব্রিটিশশাসিত আধুনিক যুগের কথা বলা হয় তা কত বড় ধোঁকা? কত বেশি 'বায়াসড' ইতিহাস?

এবার আসা যাক ভারতের ইতিহাস লেখায় আধুনিক সময়ে নেওয়া পদেক্ষপগুলোর আলোকপাতে।

২০২৩ সালের ১৪ এপ্রিল কাতারভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম আল জাজিরায় 'মুঘলস, আরএসএস, ইভোলিউশন: আউটরেজ অ্যাজ ইন্ডিয়া এডিটস স্কুল টেক্সটবুকস' শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। সেখানে প্রতিবেদক দেখান যে, কীভাবে ধর্মান্ধতার বশবর্তী হয়ে ভারতের ৯ম এবং ১০ম শ্রেণির পরীক্ষার সিলেবাস থেকে ডারউইনের বিবর্তনবাদ তত্ত্ব বাদ দেওয়া হয়েছে।

ওই সময় ভারতের পাঠ্যপুস্তক প্রণয়নের দায়িত্বে থাকা ন্যাশনাল কাউন্সিল অব এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং (এনসিইআরটি) 'শিক্ষার্থীদের বোঝা কমানোর' যৌক্তিকতা দেখিয়ে সপ্তম শ্রেণির ইতিহাস বই থেকে দিল্লি সালতানাতের মুসলিম শাসক, যেমন মামলুক, খিলজি, তুঘলক এবং লোদিদের ইতিহাস থাকা কয়েকটি পাতা বাদ দেয়। বইটি থেকে মুঘল সম্রাটদের বিভিন্ন কীর্তি ও অর্জনের উল্লেখ থাকা একটি দুই পাতার জুড়ে থাকা তালিকাও বাদ দেওয়া হয়।

জাতীয় পাঠ্যপুস্তকে ব্যাপক সংস্কারের উদ্যোগ হিসেবে ওই সময় দ্বাদশ শ্রেণির ইতিহাস বইগুলো থেকে আকবরনামা, বাদশাহনামাসহ মুঘল সাম্রাজ্যের বিভিন্ন নথিপত্র ও পান্ডুলিপি থাকা একটি অধ্যায়ও সম্পূর্ণ বাদ দেওয়া হয়।

এমনকি মহাত্মা গান্ধীর মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছিল- এনসিইআরটি একাদশ এবং দ্বাদশ শ্রেণির পলিটিক্যাল সায়েন্স বই থেকেও এ সংক্রান্ত তথ্য মুছে দেয়। বলা বাহুল্য- গান্ধীর হত্যাকারী নথুরাম গডসে ছিলেন আরএসএস ঘনিষ্ঠ একজন কট্টরপন্থি।

এনসিইআরটি একাদশ শ্রেণির পলিটিক্যাল সায়েন্স বই থেকে ভারতের স্বাধীনতা যুদ্ধের অগ্রসৈনিক মাওলানা আবুল কালাম আজাদের ইতিহাসও বাদ দিয়েছে। মাওলানা আজাদ ছিলেন ভারতের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী এবং ব্রিটিশদের থেকে স্বাধীনতাপ্রাপ্তির পর ভারতের সংবিধান রচনা কমিটির অন্যতম সদস্য।

এনসিইআরটি প্রণীত একাদশ এবং দ্বাদশ শ্রেণির পলিটিক্যাল সায়েন্স বইতে এমন একটি বাক্য ছিল- গান্ধী ভাবতেন ভারতকে 'শুধুই' হিন্দুদের দেশ বানানোর যে কোনো প্রচেষ্টা ভারতেরই ধ্বংস ডেকে আনবে। এই বাক্যটিও বই থেকে বাদ দেওয়া হয়েছে। ধীরে ধীরে যে ভারত অসাম্প্রদায়িকতা থেকে মুসলিম নিধনের মাধ্যমে হিন্দুত্ববাদী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পথে এগিয়ে গেছে তার স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া গেছে সম্প্রতি আরএসএস প্রধান মোহন ভাগবতের দেওয়া এক বক্তব্যে।

ভারতের মনিপুর রাজ্যে গিয়ে এক জনসভায় দেওয়া বক্তৃতায় তিনি বলেন, হিন্দুরা না থাকলে দুনিয়ার অস্তিত্ব থাকবে না।

তাদের ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার এই যে লক্ষ্য, এই যে প্রচেষ্টা সেটার সঙ্গে ব্রিটিশদের তৈরি করে যাওয়া একপাক্ষিক ইতিহাসের সঙ্গে মোদি জমানায় আরএসএস নিয়ন্ত্রিত ইতিহাস লিখনের সংযোগ খুঁজে পান কি?



banner close
banner close