বাংলাদেশের রাজনীতি এমন এক সন্ধিক্ষণে আজ দাঁড়িয়ে আছে যেখানে অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার সমীকরণ, আঞ্চলিক ভূ-রাজনীতি এবং জনগণের প্রত্যাশা- এই তিনটি উপাদান যুথবদ্ধ হয়ে নতুন বাস্তবতা তৈরি করছে। ২০২৬ সালের সম্ভাব্য সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে যে উত্তাপ ধীরে ধীরে বাড়ছে, তাতে পরিষ্কারভাবে বোঝা যায় যে, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক এবং আওয়ামী লীগের দীর্ঘমেয়াদি ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন-দুটি বিষয়-ই আগামী নির্বাচনের অন্যতম কেন্দ্রীয় আলোচ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশে গত তিনটি নির্বাচন, ২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ প্রতিবারই বহুমুখী বিতর্ক, রাজনৈতিক অচলাবস্থা ও আন্তর্জাতিক আগ্রহের জন্ম দিয়েছে। তবে এবারের বাস্তবতা ফ্যাসিবাদী শাসন আমলের সম্পূর্ণ বিপরীত। নিঃসন্দেহে বিগত দিনে ভারতের সর্বৈব বিতর্কিত ভূমিকা, আওয়ামী লীগের দানবনীতি এবং ২৪-এর গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী জনগণের মানসিকতার পরিবর্তন মিলিতভাবে বাংলাদেশের রাজনীতি ও আসন্ন নির্বাচন জনচেতনায় নতুন ধারা সৃষ্টি করছে।
রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট: ২০০৮ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত ফ্যাসিবাদী ক্ষমতার ধারাবাহিকতা লক্ষণীয়।
২০০৮ সালে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ ও তাদের বাংলাদেশীয় দোসরদের মাধ্যমে সুকৌশলে ষড়যন্ত্রধর্মী নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়ে মধ্য দিয়ে শুরু হয় একটি দীর্ঘ অপরাজনৈতিক অধ্যায়। পরবর্তী তিন মেয়াদে ফ্যাসিবাদী হাসিনার দলটি ‘র’ তথা ভারতের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে বাংলাদেশের রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করে। অবকাঠামোগত উন্নয়ন, ডিজিটাল ব্যবস্থার প্রবর্তন, নারী শিক্ষার প্রসার এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি -এসব গালভরা বুলিতে প্রথম প্রথম কিছুটা জনপ্রিয়তার ভিত্তি তৈরি করে ধোকাবাজ আ.লীগ। তবে একইসঙ্গে, ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ, নির্বাচন ব্যবস্থার বিতর্ক, বিরোধী দলের দমননীতি, সবক্ষেত্রে দুর্নীতি, অর্থ পাচার এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে থাকে অহরহ। ২০১৪ সালের নির্বাচন কার্যত একতরফা ছিলো। ২০১৮ সালের নির্বাচনে ভোটকেন্দ্রিক সহিংসতা ও ফজরের আযানের আগেই ডিসি-এসপি ও ‘র’ এবং এদেশীয় গোয়েন্দা সংস্থার তত্বাবধানে পুলিশ ও আনসার সদস্যরা নৌকায় সীল মেরে ব্যালটবাক্স ভর্তি করে ফেলে। এসব ভোট ডাকাতি ও চরম অনিয়মের অভিযোগ উঠলেও আওয়ামী লীগ বিষয়টিকে একেবারেই আমলে নেয়নি। আর ২০২৪ সালের নির্বাচনেও 'আমি-ডামি' সিস্টেম দেশব্যাপী ব্যাপক পরিসরে প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। এছাড়াও গত ১৭ বছরের শাসনামলে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় খুন, গুম, আয়না ঘরে বন্দী, শাপলা-চত্ত্বরে আলেম-এতিম হত্যা, যুদ্ধাপরাধের নামে তথকথিত বিচার। এসবের সাথে যে বস্তুত ভারত জড়িত তা বাংলাদেশের প্রায় শতভাগ মানুষ বিশ্বাস করে। কিন্তু ক্ষমতাসীনরা জনগণের মতামতের তোয়াক্কা না করে স্বদেশে বিদেশি প্রভুর প্রেসক্রিপশনের শাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলে। পক্ষান্তরে বিরোধী শক্তির অংশগ্রহণ না থাকায় ভারত ছাড়া সংগত কারণেই বিশ্বের সকল দেশ বাংলাদেশের নির্বাচন পদ্ধতির প্রতি নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশ করে। এই ধারাবাহিক দুঃশাসন ও আ’লীগের প্রতি ভারতের নগ্ন সমর্থন জনগণের মধ্যে ভারতবিরোধী তথা আ’লীগ বিরোধী মনোভাব সৃষ্টি করে। এবং ধীরে ধীরে ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে দেশের সর্বত্র সর্বস্তরে ক্ষোভ-বিক্ষোভ বাড়তে থাকে।
তথাকথিত বন্ধু রাষ্ট্র ভারতের ভূমিকা: কূটনৈতিক বন্ধুত্ব না কৌশলগত প্রভাব?
বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে গভীর। মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে বাণিজ্য, নিরাপত্তা ও আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা; সবক্ষেত্রেই দুই দেশের মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরতা রয়েছে। তবে এ সম্পর্কের প্রকৃতি সবসময় একমুখী বলে মনে হয় না। ভারত কখনও দক্ষিণ এশিয়ায় স্থিতিশীল মিত্র চায় না। আওয়ামী লীগকে তারা দীর্ঘদিন ধরে একটি নির্ভরযোগ্য অংশীদার হিসেবে দেখেছে। বিশেষ করে বাংলাদেশে মুসলিম নিধন, জঙ্গি নাটক মঞ্চায়ন, প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ পদে হিন্দু পদায়নসহ মুসলিম সমাজকে পঙ্গু করার ক্ষেত্রে আ’লীগের চেয়ে ভারতের আর কেউ বিশ্বস্ত সংগী এদেশে নেই। তাই বাংলাদেশের অধিকাংশ জনগণের মতোই অধিকাংশ বিরোধী দল মনে করে, দিল্লীর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ নীতিগত সমর্থনই বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের অপরাজনৈতিক ও স্বৈরতান্ত্রিক অবস্থানকে দীর্ঘায়িত করেছে। ২০২৪ সালের নির্বাচনের পরও ভারতের প্রতিক্রিয়া ছিলো নরম। বিশ্বের অন্য কোন দেশ না দিলেও তারা 'আমি-ডামি'র নির্বাচনের ফলাফলকে দ্রুত স্বীকৃতি দেয়। এই ঘটনাটি দেশপ্রেমিক শক্তির মধ্যে অসন্তোষ সৃষ্টি করে। ভারতের এই অবস্থানকে অনেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ হিসেবে দেখে।
বিরোধী রাজনীতির পরিবর্তিত কৌশল
২০১৪ ও ২০১৮ সালের পর বাংলাদেশে বিরোধী রাজনীতি একাধিকবার পুনর্গঠনের চেষ্টা করেছে। বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন-সংগ্রাম, হরতাল-অবরোধ, নির্বাচন বর্জন ও আন্তর্জাতিক কূটনীতি; এই তিন কৌশলের মধ্যেই দৃঢ়ভাবে অবস্থান করেছে। তবে ২০২৪ সালের নির্বাচনের পর বিএনপি তাদের কৌশলে কিছুটা পরিবর্তন আনে। তারা তখন জনমতের ওপর জোর দেয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয়তা বাড়ায় এবং তরুণ প্রজন্মের মধ্যে বিকল্প রাজনৈতিক বার্তা ছড়ানোর বিশেষ মিশনে নামে। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে আন্দোলনকে দীর্ঘস্থায়ী রূপ দিতে না পারায় সংগঠনটির দুর্বলতা স্পষ্ট হয়ে পড়ে। এই সুযোগে ইসলামী দলগুলো নতুন করে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। এই প্রেক্ষাপটে ‘ভারত-বিরোধিতা’ অনেকের কাছে একটি সহজ ও আবেগপূর্ণ রাজনৈতিক বার্তা হয়ে দাঁড়ায়। এটি কোনো নির্দিষ্ট দলের একচ্ছত্র ইস্যু নয়; বরং জাতীয়তাবাদী ও ইসলামী আবেগের প্রতীক হিসেবে শক্তিশালী অবস্থানে উপনীত হয়। ইসলাম, জাতীয়তাবাদী আবেগ ও ভারতবিরোধী প্রবণতা বাংলাদেশেরে মানুষকে জাগিয়ে তোলে। বাংলাদেশের জনমনে ভারতের প্রতি মিশ্র অনুভূতি রয়েছে আগে থেকেই। একদিকে মুক্তিযুদ্ধের কৃতজ্ঞতা ও ঐতিহাসিক সম্পর্ক, অন্যদিকে সীমান্ত হত্যা, পানি বণ্টন ইস্যু ও বাণিজ্য বৈষম্য নিয়ে দীর্ঘদিনের ক্ষোভ বিদ্যমান। তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়ন না হওয়া কিংবা সীমান্তে পুনঃপুন বাংলাদেশি নাগরিক হত্যার কারণে সাধারণ মানুষের মনে ভারতের প্রতি নেতিবাচক প্রভাব দীর্ঘদিনের। এই আবেগ রাজনৈতিকভাবে রূপান্তরিত। এবং এটি আওয়ামী লীগবিরোধী শক্তিতে পরিণত। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, ইউটিউব এবং অনলাইন পোর্টালগুলিতে এখন আ’লীগ তথা ভারতবিরোধী প্রবণতা স্পষ্ট। তরুণ প্রজন্ম ভারতের প্রভাবমুক্ত পররাষ্ট্রনীতি ও সার্বভৌম রাজনৈতিক অবস্থান দাবি করছে। বাংলাদেশের মোট ভোটারের প্রায় এক-তৃতীয়াংশই ১৮ থেকে ৩৫ বছরের মধ্যে। এদের বড় অংশ প্রথমবারের মতো ভোটার হয়েছে ২০১৮ বা ২০২৪ সালের নির্বাচনে। তাদের কাছে রাজনীতি মানে শুধু দলীয় আনুগত্য নয়, বরং রাষ্ট্রের দিকনির্দেশনা ও ন্যায়বিচারের প্রশ্ন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, তাই আজ বাংলাদেশের রাজনৈতিক মঞ্চের বিকল্প। ফেসবুক, ইউটিউব টুইটারে সর্বত্র রাজনৈতিক আলোচনা, তর্ক ও প্রচারণা চলছে। তরুণরা এখানেই মত গঠন করে, সংবাদ সংগ্রহ করে এবং সিদ্ধান্ত নেয়। ফলে ২০২৬ সালের নির্বাচনে ডিজিটাল প্রোপাগান্ডা ও অনলাইন জনমত একটি বড় ভূমিকা রাখতে পারে। এই প্রজন্ম অনেক বেশি সচেতন। তারা ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব চায়, কিন্তু প্রভাব নয়। কোন আধিপত্য তারা মানবে না। তারা উন্নয়ন চায়, কিন্তু অংশগ্রহণও চায়। তাই বিএনপি ও অন্যান্য দল দু’পক্ষকেই এই প্রজন্মের মনোভাব বুঝে কৌশল সাজাতে হবে। বাংলাদেশের আগামী সংসদ নির্বাচন ২০২৬ সালের প্রথমভাগে অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। নির্বাচন কমিশন ইতিমধ্যে অনেক প্রস্তুতি শেষ করেছে। এ সময় পর্যন্ত রাজনৈতিক আবহ কীভাবে পরিবর্তিত হয়, তা-ই নির্ধারণ করবে নির্বাচনের রূপ ও ফলাফল। তবে তা অবশ্যই আ’লীগ তথা ভারত বিরোধীতার উপর নির্ভর করবে।
বাংলাদেশের রাজনীতি আজ রূপান্তরের পথে। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক, আওয়ামী লীগের দীর্ঘমেয়াদি দুঃশাসন এবং জনগণের পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা এই তিনটি উপাদান মিলে আগামী নির্বাচনের মূল কাঠামো তৈরি করছে। ভারতবিরোধিতা ও আওয়ামী বিরোধিতা মূলত একই আবেগের দুটি দিক। একদিকে সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন, অন্যদিকে গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণের দাবি। কিন্তু এই আবেগকে যদি গঠনমূলক রাজনীতিতে রূপ দেওয়া যায়, তবে তা দেশকে স্থিতিশীলতা ও ভারসাম্যের পথে নিয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের জনগণই ঠিক করবে, তারা কেমন রাজনীতি চায়। বিগত দিনের মতো ভারত-প্রভাবিত রাজনীতি নাকি স্বাধীন সিদ্ধান্তের বাংলাদেশী রাজনীতি। তাই ২০২৬ সালের নির্বাচন শুধু ক্ষমতার পালাবদল নয়; এটি বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রদর্শন নির্ধারণের এক ঐতিহাসিক সুযোগ।
লেখক: কলামিস্ট ও রাজনীতি বিশ্লেষক
আরও পড়ুন:








