ইতিহাসের পাতা উল্টালে দেখা যায়, মানবজাতির নিরাপত্তার অন্যতম প্রধান উৎস হলো ঐক্য। আদিমকালে প্রাগৈতিহাসিক মানুষ কেবল শক্তিশালী হিংস্র বন্য প্রাণীর আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতেই নয়, বরং সম্মিলিতভাবে প্রাণী শিকার করে জীবনধারণের প্রয়োজনে পারিবারিক ও গোষ্ঠীগত ঐক্য গড়ে তোলার প্রয়োজন অনুভব করেছিল। প্রাচীন মানুষের সেই সমাজবদ্ধতা থেকেই জন্ম নিয়েছিল নেতৃত্ব এবং রাষ্ট্রের ধারণা, যা কালের পরিক্রমায় রাজনৈতিক বিবর্তনের দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়েছে। বিখ্যাত মুসলিম দার্শনিক ইবনে খালদুন ‘আল মুকাদ্দিমা’ গ্রন্থে বলেছেন, আসাবিয়্যাহ (ঐক্য) হলো রাজনৈতিক ক্ষমতার মূল ভিত্তি, যা গোষ্ঠী বা সমাজের মানুষকে একে অপরের সাথে যুক্ত করে।
আজকের একবিংশ শতকে দাঁড়িয়ে আমরা সেই হাজার বছরের ইতিহাসের অবলোকন ও পর্যালোচনার সুযোগ পাচ্ছি। এই পর্যালোচনা থেকে এটি স্পষ্ট যে, যখনই অভ্যন্তরীণ ঐক্য দুর্বল হয়েছে, তখনই বহিঃশক্তির আগ্রাসন তীব্র হয়েছে। সামন্ত রাজাদের পারস্পরিক দ্বন্দ্ব ও প্রতিবেশীদের সাথে বৈরী সম্পর্কের কারণে ভিনদেশ থেকে আসা দিগ্বিজয়ী রাজা, বেনিয়া ও সুলতানরা সহজেই একে একে রাজ্য দখল করে বৃহত্তর উপনিবেশ কিংবা সাম্রাজ্য গঠনের সুযোগ পেয়েছিল। এই উপমহাদেশের ইতিহাসেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি।
মুসলমান সুলতান ও মুঘল সম্রাটরা নিজেদের মহানুভবতার গুণে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর মধ্যকার বিরোধ-বৈরিতা নিরসন করে শত শত বছর ধরে এ উপমহাদেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতার নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলতে সক্ষম হলেও, অষ্টাদশ শতকে ইউরোপীয় উপনিবেশবাদীদের আগমনে পরিস্থিতি সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। বিশেষত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা কেবল বাণিজ্যের মোহে রাষ্ট্র দখলের পর থেমে থাকেনি; তারা এ উপমহাদেশের চিরস্থায়ী ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থা গড়ে তুলতে স্থানীয় জাতি-গোষ্ঠী ও ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে সুপরিকল্পিতভাবে বিভেদ-বৈরিতা সৃষ্টি করেছিল। মূলত নতুন পুঁজিবাদী ধ্যানধারণা ও যুদ্ধজাহাজের উপর ভর করে পশ্চিমা রাষ্ট্রদার্শনিকরাও ইউরোপের বাইরে উপনিবেশ বিস্তারের কর্মযজ্ঞে মনোযোগ দিয়েছিলেন। পুঁজির জৌলুস, সুপ্রশিক্ষিত সামরিক জনবল ও সমরাস্ত্রের বলে বলিয়ান পশ্চিমারা নিজেদের মধ্যে আন্তঃরাষ্ট্রীয় প্রতিযোগিতায় এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলো থেকে শিল্পের কাঁচামাল, খনিজ ও জনশক্তি আহরণ করে ভবিষ্যতের সাম্রাজ্য গড়ে তোলার লক্ষ্যেই দেশে দেশে নাগরিকদের মধ্যে ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ পলিসি বা ‘বিভাজন ও শাসন’ নীতি গ্রহণ করেছিল। তাদের এই কৌশল ছিল শত শত বছর ধরে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থানকারী প্রধান প্রধান ধর্মীয় সম্প্রদায়গুলোর মধ্যে বিভাজন, অবিশ্বাস-অনাস্থা ও বৈরীতার উপকরণগুলো উস্কে দিয়ে ফায়দা নেওয়া।
রাজনৈতিক ঐতিহাসিকদের মতে, ব্রিটিশদের আগমনের পূর্বে ভারতে হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে কোনো জাতিগত বৈরিতা বা দ্বন্দ্ব-সংঘাত ছিল না। অযোধ্যায় বাবরি মসজিদের নিচে রামের জন্মভূমি আবিষ্কারের মূল হোতা ছিল ব্রিটিশ রাজনৈতিক ঐতিহাসিকরা। ঐতিহাসিক তথ্যে দেখা যায়, বাবরের সেনাপতি মীর বাকি ১৫২৮ সালে বাবরি মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। আর তুলসিদাসের জীবৎকাল ছিল ১৫১১ থেকে ১৬২৩ সালের মধ্যে এবং রামচরিতমানস প্রকাশিত হয়েছিল ১৫৫৮ সালে বা তার পরে। অথচ তুলসিদাসের রামচরিতমানস বা সে সময়কার অন্য কোনো পুস্তক বা লোককাহিনীতে কোথাও লেখা নেই যে মীর বাকি রামমন্দিরের উপর মসজিদ নির্মাণ করেছিলেন। বিংশ শতকে এসে ব্রিটিশরাই প্রথম এই তথ্য ছড়িয়ে দাঙ্গা বাধিয়েছিল। তবে ব্রিটিশরা হিন্দু-মুসলমান বিরোধকে কাজে লাগালেও তাদের সাম্রাজ্যিক স্বার্থে তা নিয়ন্ত্রনহীনভাবে বাড়তে দেয়নি।
১৯৪৭ সালের পর থেকে রাজনৈতিক মেরুকরণ এবং ক্ষমতাকেন্দ্রিক উচ্চাকাঙ্ক্ষার ফলস্বরূপ রামমন্দির ও সীমান্তবিরোধ সংক্রান্ত উত্তেজনা ও বৈরীতা নতুন করে বাড়তে শুরু করে। ভারতের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির মূল উপাদানই হচ্ছে হাইপোথেটিক্যাল পৌরাণিক কাহিনীনির্ভর উচ্চাভিলাষী রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ন্যারেটিভ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা নিরঙ্কুশ রাখা। এ ক্ষেত্রে তারা প্রবলমাত্রায় বর্ণবাদী হয়েও নিম্নবর্ণের হিন্দুদের মধ্যে মুসলিম বিদ্বেষ উস্কে দিয়ে ভোটের রাজনীতিতে ফায়দা হাসিলের কৌশল গ্রহণ করে সফল হয়েছে।
অন্যদিকে, সামাজিক-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতির প্রশ্নে নানামুখী প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও শতকরা ৯০ ভাগের বেশি মুসলমানের বাংলাদেশে উগ্র সাম্প্রদায়িকতা কখনো শক্তভাবে দাঁত বসাতে পারেনি। ১৯৪৭ সালের পর থেকেই এ দেশ ধর্মীয় স্বাধীনতা ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তবে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদ কিংবা ভারতীয় হিন্দুত্ববাদীরা এই সম্প্রীতি নষ্ট করতে এখানেও ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ পলিসি কাজে লাগাতে এখানকার রাজনৈতিক দল ও ক্ষমতার রাজনীতিকে সহজেই ব্যবহার করতে চাইছে। পশ্চিমা নিউ ওয়ার্ল্ড অর্ডার অথবা ওয়ার অন টেরর-এর আওতায় আঞ্চলিক-আন্তর্জাতিক পরাশক্তিসমূহের ভূরাজনৈতিক কৌশলগত ভেদরেখা কাজে লাগিয়ে আঞ্চলিক আধিপত্যবাদী শক্তি ভারত উপমহাদেশের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রগুলোর উপর খবরদারি ও দখলদারিত্ব বজায় রাখতে পশ্চিমাদের কাছ থেকে বিশেষ ছাড় পেয়ে এসেছে।
বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন ব্যবস্থাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দেড়যুগ ধরে প্রথমে ওয়ান-ইলেভেনের অগণতান্ত্রিক-অসাংবিধানিক সেনাসমর্থিত অন্তর্বর্তী সরকার, অতঃপর চারটি বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামী ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েমের মূল পৃষ্ঠপোষক ও রক্ষক ছিল ভারতের ডিপ স্টেট। এই ডিপ স্টেট কথাটির তাৎপর্য এই যে, বাংলাদেশে আধিপত্যবাদী নীতির প্রশ্নে কংগ্রেসের মনমোহন সিং কিংবা বিজেপির নরেন্দ্র মোদির মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য বা মতবিরোধ নেই। এমনকি নরেন্দ্র মোদির হেজিমনিক এজেন্ডার সাথে রাহুল গান্ধী বা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়েরও তেমন কোনো মতবিরোধ দেখা যায়নি। বরং জুলাই অভ্যুত্থানের পর বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মোদি সরকারের আগ্রাসী কর্মকাণ্ডে রাহুল গান্ধী প্রকাশ্য সমর্থনও করেছেন, যা ভারতীয় রাজনীতির এই দীর্ঘস্থায়ী আধিপত্যবাদী নীতির অভিন্নতাকেই তুলে ধরে। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ধ্বংস করে শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদী শাসনের প্রধান সুবিধাভোগী ও পৃষ্ঠপোষক ভারত বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের প্রত্যাশা ও সমর্থনের চেয়ে তাদের বশংবদ শেখ হাসিনা, তার পরিবার ও আওয়ামী লীগকেই বেছে নিয়েছে।
২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে ভারতে পালিয়ে যাওয়ার পর একটি পরিবার ও গণপ্রত্যাখ্যাত দলের প্রতি ভারতের ইন্ট্রা-নেপোটিজম বা অভ্যন্তরীণ স্বজনপ্রীতি আগের চেয়েও উলঙ্গভাবে ধরা পড়েছে। গত চৌদ্দ মাসে ভারত-বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সম্পর্ক ও স্বার্থ বড় ধরনের ঝুঁকির মুখে পড়লেও, অভ্যুত্থান-পরবর্তী অন্তর্বর্তীকালীন পরিস্থিতিতে ভারত একটি গণতান্ত্রিকভাবে প্রত্যাখ্যাত এবং স্বৈরাচারী শক্তির প্রতি তাদের প্রকাশ্য সমর্থন অব্যাহত রেখেছে। এই আচরণ বাংলাদেশের জনগণের দীর্ঘদিনের গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা এবং একটি সুস্থ দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মৌলিক নীতির পরিপন্থী। ভারতের এই কৌশলগত সিদ্ধান্ত আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার জন্য ক্ষতিকর হতে পারে, কারণ জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে গিয়ে কোনো একটি পক্ষের প্রতি একতরফা সমর্থন দীর্ঘমেয়াদে কেবল অবিশ্বাস ও বৈরীতারই জন্ম দেবে।
পরিশেষে আবারও বলি, ইতিহাস বারবার প্রমাণ করেছে যে, ঐক্যই হলো নিরাপত্তার প্রধানতম ভিত্তি। কিন্তু সেই ঐক্যকে দুর্বল করে সাম্রাজ্যবাদী কৌশল যুগে যুগে রাজনৈতিক সংকট তৈরি করেছে। একবিংশ শতকে এসে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিবর্তনেও আমরা সেই ভূরাজনৈতিক আধিপত্যের খেলা দেখতে পাচ্ছি। আঞ্চলিক পরাশক্তির এই একপেশে নীতি এবং একটি ফ্যাসিবাদী সরকারের প্রতি তার অন্ধ সমর্থন কেবল বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারকেই ক্ষুণ্ন করেনি, বরং তা উপমহাদেশের ভবিষ্যৎ শান্তি ও আস্থার সম্পর্ককেও গভীর সংকটের মুখে ঠেলে দিয়েছে। এই পরিস্থিতিতে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা ও জনগণের আস্থা ফেরাতে হলে অবশ্যই গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি সম্মান জানাতে হবে এবং বাংলাদেশের ১৮ কোটি মানুষের প্রত্যাশাকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
ফাহিম হাসনাত
জবি প্রতিনিধি, বাংলা এডিশন।
দপ্তর সম্পাদক, জগন্নাথ ইউনিভার্সিটি ফিচার কলাম এন্ড কনটেন্ট রাইটার্স।
আরও পড়ুন:








