বিবিসিতে প্রচারিত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের দুই পর্বের সাক্ষাতকার বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন মাত্রা যোগ করেছে। অনেকেই এটিকে শুধু একটি সাক্ষাৎকার হিসেবে নয়, বরং একটি রাজনৈতিক ঘোষণা হিসেবেও দেখছেন, যা উচ্চারণে সংযমী কিন্তু তাৎপর্যে বজ্রনিনাদসম।
প্রথম সাক্ষাতকারেই অনেকে বিস্মিত হয়েছিলেন। কারণ তিনি একবারও ভারতীয় এজেন্সি কিংবা পতিত ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার নাম উচ্চারণ করেননি। বিষয়টি প্রথমে কিছুটা হতাশাজনক মনে হলেও পরবর্তীতে সেটি গভীরভাবে মনোমুগ্ধকর বলে মনে হয়েছে। কারণ তিনি তাঁর পুরো সাক্ষাতকারে “ভারত” কিংবা “হাসিনা” এই দু’টি শব্দ একবারের জন্যও উচ্চারণ করেননি। পুরো সাক্ষাৎকারটি মনোযোগ দিয়ে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তিনি বেশ কিছু শব্দ বারবার ব্যবহার করেছেন, যার মধ্যে ‘জনগণ’ শব্দটি উচ্চারণ করেছেন প্রায় ২৫ বার, ‘বাংলাদেশ’ ১৮ বার, আর ‘গণতন্ত্র’ শব্দটি এসেছে ১২ বার।
ক্ষোভ, ঘৃণা ও দৃঢ় অবস্থান এই তিনের চরম প্রকাশই হয়তো এমন যে, শত্রুর নাম উচ্চারণ করাও অনেক সময় অযথা মনে হয়। কাজেই আওয়ামী খুনিচক্র কিংবা ভারতীয় আগ্রাসনের প্রশ্নে বিএনপি যে ভবিষ্যতে কোনো ছাড় দেবে না, সেটি তারেক রহমানের বক্তব্যেই অনেকটাই স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে। তাই ভারত ও আওয়ামী লীগ প্রশ্নে তার অবস্থান যদি সত্যিই দৃঢ় থাকে, তবে এই সাক্ষাৎকারে হতাশার কিছু নেই, বরং এটি জুলাইয়ের স্বপক্ষের দেশপ্রেমিক শক্তিগুলোর জন্য এক আশাব্যঞ্জক বার্তা।
দ্বিতীয় পর্বে বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে। বিবিসির উপস্থাপক মীর সাব্বির ও তার সহকারী কাদির কল্লোল এই পর্বে বারবার ‘ভারত’ প্রসঙ্গ টেনে এনে তাঁকে কথা বলাতে চেয়েছেন। খেয়াল করলে দেখা যাবে, উপস্থাপক ‘ভারত’ শব্দটি কমপক্ষে পাঁচবার উচ্চারণ করেন। কিন্তু প্রত্যুত্তরে তারেক রহমান একবারের জন্যও ‘ভারত’ নামক বিষাক্ত শব্দটি মুখেও আনেননি।
অনেকের মনে হতে পারে এটি শুধুই এড়িয়ে যাওয়া, তবে আমরা মনে করি এটি তাঁর এক দৃঢ় রাজনৈতিক অবস্থান। কারণ তিনি জানেন, শত্রুর নাম উচ্চারণ মানেও তাকে এক প্রকার রাজনৈতিক বৈধতা দেয়া, আর তিনি সেই সুযোগ দেননি। তাঁর বক্তব্য বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তিনি এই ইস্যুতেই বেশ কিছু শব্দ বারবার ব্যবহার করেছেন। যার মধ্যে শুধু ‘সার্বভৌমত্ব’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন কমপক্ষে ২ বার, ‘ফেলানি হত্যা’ ৩ বার, ‘পানির হিস্যা’ ৪ বার, ‘সংস্কার’ ৮ বার, ‘গণতন্ত্র’ ৭ বার, এবং ‘সবার আগে বাংলাদেশ’ শব্দটি অন্তত ৮ বার।
এই পুনরাবৃত্তি নিছক কাকতালীয় নয়। এটিও হতে পারে কোনো রাজনৈতিক সংকেত। এটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও স্বার্থের প্রশ্নে কোনো বিদেশি শক্তির মুখাপেক্ষী নয়, বরং আত্মমর্যাদার ভিত্তিতে সম্পর্ক গঠনের ঘোষণাও হতে পারে।
বিশেষ করে উপস্থাপক যখন তাঁকে সরাসরি প্রশ্ন করেন, ‘ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্ক কেমন হবে?’ তখন তিনি অত্যন্ত সুকৌশলে জনমানুষের আবেগকে সম্মান জানিয়ে উত্তর দেন, ‘বাংলাদেশের মানুষ সিদ্ধান্ত নিয়েছে তাদের সাথে সম্পর্ক শীতল থাকবে, সুতরাং আমাকে আমার দেশের মানুষের সাথে থাকতে হবে।’ এই সংক্ষিপ্ত অথচ তাৎপর্যপূর্ণ বাক্যেই তারেক রহমান যেন ভবিষ্যৎ ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার রূপরেখাও এঁকে দিয়েছেন। তিনি সরাসরি ‘ভারতবিরোধিতা’ করেননি, তবে তাঁর বক্তব্যের প্রতিটি শব্দেই ভারতের নীতির প্রতি এদেশের জনগণের পুঞ্জিভূত ক্ষোভ, অবিশ্বাস ও বিতৃষ্ণা প্রতিধ্বনিত হয়েছে।
এর মাধ্যমে তিনি আরো স্পষ্ট করে দিয়েছেন, বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ ভারতের প্রতি তাদের কৃতকর্মের কারণে এক ধরনের ক্ষোভ, অবিশ্বাস ও ঘৃণা পোষণ করতে শুরু করেছে। এর ফল হিসেবে ভবিষ্যতে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক আর আগের মতো ‘স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের’ মতো উষ্ণ বা ঘনিষ্ঠ থাকবে না। বরং এর মধ্যে দূরত্ব থাকবে, হবে শীতল ও সংযমনির্ভর। তিনি মূলত ইঙ্গিত দিয়েছেন, ভারতের প্রতি জনগণের এই ক্ষুব্ধ মনোভাব অবশ্যই রাষ্ট্রীয় নীতির ওপর প্রভাব ফেলবে এবং সেটি নিঃসন্দেহে ভারতের জন্য ইতিবাচক হবে না। আর এ বক্তব্যেও তারেক রহমানের দেশপ্রেম, জনআবেগের প্রতি শ্রদ্ধা এবং ভারতীয় আধিপত্যবাদের প্রতি তাঁর দৃঢ় অবস্থান স্পষ্টভাবে প্রতিফলিত হয়েছে।
আরেকটি তাৎপর্যপূর্ণ দিক হলো, যখন সাংবাদিক কাদির কল্লোল বলেন, ‘আমি একটু পেছনে তাকাতে চাই।’ তখন তারেক রহমান স্বভাবসুলভ হেসে জবাব দেন, ‘ভাই, আমরাতো সামনে যেতে চাই। আপনি পেছনে কেন যাবেন? দেশকে সামনে নিতে হবে।’ গভীর দার্শনিক দিক-নির্দেশনা সম্পন্ন এই একটি সংলাপেই যেন স্পষ্ট হয়ে যায়, তিনি অতীতে আটকে থাকা রাজনীতির প্রতিনিধি হতে চান না, বরং তিনি সেই বাংলাদেশ দেখতে চান, যে দেশ এগিয়ে যাবে নিজের সম্ভাবনা, নিজের মর্যাদা আর নিজের স্বাধীন সত্তা নিয়ে।
বাংলাদেশের মানুষ বহু দেখেছে, কেউ ‘চেতনা’র নাম করে ক্ষমতার দোকান খুলেছে, কেউ মুক্তিযুদ্ধের আবেগ বিক্রি করে দেশ বিকিয়েছে। কিন্তু তারেক রহমানের বক্তব্যে নেই সেই ভণ্ড চেতনার বাগাড়ম্বর। তাঁর কথায় নেই প্রতিহিংসা, আছে আত্মবিশ্বাস; নেই ঘৃণা, আছে দিক-নির্দেশনা।
তাই বলা যায়, দুই পর্বের এই সাক্ষাতকারে জনাব তারেক রহমান ভারতীয় আগ্রাসন ও আওয়ামী খুনিচক্রের বিরুদ্ধে নীরব উচ্চারণে যে বজ্রনিনাদ শোনালেন, সেটিই পারে আগামীর বাংলাদেশ বিনির্মাণের ঘোষণাপত্র। বাংলাদেশের মাটিতে ভারতীয় আধিপত্যবাদকে বারবার চপেটাঘাত করা, বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের প্রবর্তক, দেশের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমান এবং আপোষহীন নেত্রী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া দম্পতির শৌর্যবীর্যের উত্তরাধিকার তারেক রহমানকে সেই অটল দেশপ্রেমিক অবস্থানে অনঢ় দেখতে চায় এদেশের জনগণ, যেখানে বিদেশি প্রভুত্বের স্থান নেই।
কারণ দীর্ঘ পথপরিক্রমার অভিজ্ঞতায় এদেশের জনগণের মনে বদ্ধমূল বিশ্বাস জন্মেছে যে, এই জনপদে যে যতোবেশি ভারতবিরোধী, সে ততোবেশি দেশপ্রেমিক। আমরা চাই, তিনি যা বিশ্বাস করেন তা যেনো ফুটে ওঠে তাঁর কর্ম, নীতি আর রাষ্ট্রিক ভাবনায়।
লেখকঃ কাজী আশফিক রাসেল
তরুণ কলামিস্ট ও হিউম্যান রাইটস অ্যাক্টিভিস্ট
গ্রাজুয়েট, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
আরও পড়ুন:








