বাংলাদেশ ও ভারত দক্ষিণ এশিয়ার দুই প্রতিবেশী রাষ্ট্র। দুইরাষ্ট্রের সম্পর্ক বহুমাত্রিক। ইতিহাস, সংস্কৃতি, সংশ্লিষ্ট নদনদী, সীমান্ত, বাণিজ্য, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক সমস্যা ও সুযোগ, সব মিলিয়ে সম্পর্ক জটিল ও স্পর্শকাতর। এই সম্পর্কের পেছনে অতীত ও বর্তমানের বিভিন্ন কর্মসূচি ও উত্তেজনা কাজ করে। সম্প্রতি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের একটি দুর্গাপূজা মণ্ডপে ‘অসুর’ প্রতিমূর্তিতে ঢোকানো হয়েছে বাংলাদেশের বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনুসকে। এই ঘটনা শুধু সাংস্কৃতিক বা শিল্প রসিকতা হিসেবে দেখার সুযোগ নেই। এটি রাজনীতি, কূটনীতি ও সম্পর্কের স্তরে উত্তেজনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটি মূলত বাংলাদেশকে-ই ‘অসুর’ হিশেবে চিত্রিত করার হীনচেষ্টার নামান্তর। এর মাধ্যমে বাংলাদেশ-ভারতের সাম্প্রতিক সম্পর্কের সংকট ঘণীভূত হচ্ছে এবং সম্পর্কের সরল গতিপথ বদলে যেতে পারে।
দুই দেশের উত্তর-পূর্ব ও পশ্চিম বঙ্গ অঞ্চলে ভাষা, সংস্কৃতি, বাঙালি ইতিহাস ও সংস্কৃতির মিল রয়েছে। সীমান্তবর্তী অঞ্চলের মানুষ-সম্পর্ক ও পারস্পরিক যোগাযোগ অনেক ক্ষেত্রেই ঘনিষ্ঠ। ১৯৭২ সালে ‘মৈত্রী চুক্তি’ হয়, যা দু’দেশের মধ্যে কূটনৈতিক ও সহযোগিতার ভিত্তি হিশেবে কাজ করেছে। বিভিন্ন ক্ষেত্র যেমন: বাণিজ্য, রেলপথ, সড়ক যোগাযোগ, নদনদী ব্যবহার, ট্রানজিট ও অর্থনৈতিক পারস্পরিক বিনিয়োগ, দুই দেশ বহু চুক্তি ও উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। ২০১৫ সালে ভারতীয় সংসদ বাংলাদেশী কূটনীতিকদের উপস্থিতিতে ভারতের সংবিধানের সংশোধন দ্বারা ভারতের রাজ্যের অংশ হিসেবে ১৯৭৪ সালের স্থলসীমানা চুক্তি অনুমোদন করে, যা সীমান্ত বিবাদে দীর্ঘদিনের সিটমহল চ্যালেঞ্জ কমিয়ে দেয়। এবং এর মাধ্যমে সিটমহল সমস্যার সমাধান হয়।
সর্ম্পকের টানাপোড়েন
ভারতের আধিপত্যবাদী স্বভাব ও আচরণের কারণে স্বাধীনতার পর থেকে আজ অবধি বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক আসলেই মানসম্মত নয়। ভারত, চীন-পাকিস্তানকে যে দৃষ্টিতে দেখে, বাংলাদেশকেও একই দৃষ্টিতে দেখে। স্বাধীনতার পর থেকে গত আগস্ট’২৪ থেকে দুই দেশের মধ্যে কূটনৈতিক উত্তাপ দেখা গেছে সবেচেয়ে বেশি। সীমান্ত সংক্রান্ত বিবাদ, বাণিজ্যিক টানাপোড়েন এবং রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক ঘটনায় মতানৈক্য বেড়েছে। যদিও একই সময়ে সরকারি পর্যায়ে কথাবার্তা ও সীমান্ত-স্তরের সমন্বয়ও চলছে। এবার পশ্চিমবঙ্গের কয়েকটি দুর্গাপূজা মণ্ডপে আন্তর্জাতিক/রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ‘অসুর’ বা নেতিবাচক রূপে প্রদর্শনের মতো বিতর্কিত কর্মকাণ্ড ব্যাপক সমালোচনার বিষয় হয়ে উঠে। যার মধ্যে একটা মণ্ডপে রাষ্ট্রীয়-সামাজিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের সরকার প্রধানের রূপকচিত্র তৈরি হওয়া ব্যাপক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দু ছিলো। এটি দুই দেশের সম্পর্ক- অনুভূতিকে মারাত্মক প্রভাবিত করেছে। এছাড়াও প্রতিদিনের অনুপ্রবেশ, চোরাচালান, ‘পুশ-ইন’ (অনুপ্রবেশ ঠেকাতে একপেশে ধাক্কা) সীমান্তে উত্তেজনা বাড়ায়। দুই দেশের সীমানা-বিষয়ক উচ্চস্তরের আলোচনায় এসব বিষয় নিয়মিত উঠে আসে। সম্প্রতি উভয়পক্ষ কিছু পদক্ষেপ নিয়ে আলোচনা চালাচ্ছে এবং নীতিগতভাবে সীমান্ত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করার বিষয়ে কিছু বিবৃতি/চুক্তি এসেছে। কিছু ঘটনা যেমন: সাম্প্রতিক খাগড়াছড়িতে সৃষ্ট অস্থিরতায় ভারতের ভূমিকা থাকার অভিযোগ উঠেছে। হিন্দুস্তান তা খণ্ডন করেছে ও ‘ভিত্তিহীন’ বলে প্রতিক্রিয়া দিয়েছে এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিবৃতি দিয়ে পরিষ্কার করেছে। এই রকম পারস্পরিক বক্তব্য-বিবৃতি দুই দেশের কূটনৈতিক আবহকে তীব্র করে। উত্তর-পূর্ব ভারতের কিছু রাজ্যে অভিবাসী/সংখ্যালঘু বিষয়ে কঠোর পদক্ষেপ ও ‘পুশব্যাক’-এর মতো অভিযোজন রিপোর্ট হয়েছে। এসব বিষয় সীমান্ত ও বাঙালি/মুসলিম-সম্প্রদায়ের ওপর চাপ সৃষ্টি করে এবং ঢাকা-নয়াদিল্লি যোগাযোগে তিক্ততা যোগ করে। এই মানবিক ও নীতিগত ইস্যুগুলো দ্বিপাক্ষিক আস্থা ও জনধারণাকে প্রভাবিত করছে। দীর্ঘমেয়াদে বাণিজ্য, অবকাঠামো সংযোগ (রেল/রোড/বিদ্যুৎ/গ্যাস ট্রানজিট) ও জলের ব্যবহার-ই দুই দেশের সহযোগিতার মূল জায়গা। তবে ব্যবসায়িক ও আমদানি-রপ্তানি বাধার বা অনাকাঙ্ক্ষিত নীতিগত সিদ্ধান্ত হলে তা রাজনৈতিক উত্তাপে নতুন আগুন ঢালে। সাম্প্রতিক সংবাদ বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে, বাণিজ্য-জনিত নীতিগত চাপও দূরত্ব বাড়ানোর একটি কারণ। একে-অপরের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি (শাসক-বিরোধী দামামা) প্রায়শই দুই দেশের কূটনীতিতে প্রতিফলিত হয়। বাইরে থেকে অভ্যন্তরীণ ঘটনা-প্রভাব থাকলে পারস্পারিক আস্থাভঙ্গ হয়। কাঁটাতারের মাঝে মানুষের জীবন, চোরাচালান, সীমান্ত হত্যাকাণ্ড এসবই পেশাগত ও আবেগগতভাবে উত্তেজনা সৃষ্টি করে। অভিবাসন/নাগরিকত্ব বিষয়ক কড়াকড়ি বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের মাত্রাকে প্রভাবিত করে। ভারতের সাম্প্রদায়িকতা ও মানবতাবিরোধী কার্যক্রম ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। সীমান্তে সংঘাত কমাতে, হত্যাকাণ্ড বন্ধ করার লক্ষ্যে দু’পক্ষ মাঝে মাঝে প্রাতিষ্ঠানিক আলোচনা করছে। কিন্তু আস্থা পুরোপুরি ফিরে আসে না: রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ঘটনাগুলো দ্রুত আস্থা নষ্ট করছে। মিডিয়া-চাঞ্চল্য এবং জনতার ক্রিয়াকলাপ তা বাড়ায়।
সাম্প্রতিক অবস্থা ও উত্তেজনা
বর্তমানে (২০২৪–২০২৫ সাল) একটি বিশেষ প্রসঙ্গ হলো যে, বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের পর ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক কিছুটা উত্তেজনায় এসেছে। বহু সংবাদমাধ্যম এবং বিশ্লেষকরা বলেছেন যে, নতুন (অন্তর্বর্তী) সরকারের প্রতি ভারতের নীতি, সংবাদ মাধ্যমে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়ে ভারতের ভূমিকা, সীমান্ত ইস্যু ইত্যাদি বিষয় দুই দেশের মধ্যে আস্থা-হ্রাসের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ড. ইউনূসের অসুর প্রতিকৃতি: ঘটনা ও বিতর্ক
সম্প্রতি ভারতীয় পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদের বহরমপুর অঞ্চলে একটি দুর্গাপূজা মণ্ডপে ‘অসুর’ (রাক্ষস) হিসেবে চিত্রিত করা হয়েছে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ বাংলাদেশ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে। এই মণ্ডপে শুধু ড. ইউনূসই নয়; তার পাশাপাশি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফের বিচ্ছিন্ন মাথা (বা অংশ) এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতিকৃতি মূর্তিতে রাখা হয়। অবশ্য মণ্ডপ কর্তৃপক্ষের দাবি এটি শুধু ‘ধ্বংসের’ প্রতীক। এই মণ্ডপের কমিটি বলেছে, তারা একটি প্রতীকী মেসেজ দিতে চেয়েছে ‘জাতির প্রতি হুমকি দূর করা’, ‘অত্যাচার ও হুমকি হটানো’ এমন কিছু ভাবনায়। আবার বাংলাদেশেও কোন কোন পুজামন্ডপে ‘অসুর’ হিসেবে মুখে দাড়ি-সম্বলিত প্রতিকৃতি দেওয়া হয়েছে, যা পরিষ্কারভাবে সাম্প্রদায়িক চেতনা থেকে করা হয়েছে। এর পেছনে ‘র’ এর প্রত্যক্ষ সংশ্রব থাকতে পারে। কারণ এসব উস্কানিতে পা দিয়ে কেউ পূজায় আক্রমণ করলে সেটিকে সাম্প্রদায়িক নিপীড়ন হিসেবে বর্হিবিশ্বে প্রচার করবে ভারত। এমন একটি হীন অপচেষ্টা ও ষঢ়যন্ত্র ছিলো। এই সমস্ত প্রদর্শনী শুধুই ‘শিল্পরাজনীতি’ বা রসিকতা নয়, বরং এতে রয়েছে ন্যূনতম সৌজন্য, কূটনীতি ও সম্পর্কের বিপজ্জনক দিক। অনেক বিশ্লেষক বলছেন, পূজামণ্ডপে দেব-অসুরের মতো ধর্মীয় ও পৌরাণিক প্রতীক ও বিষয়গুলোকে সংবেদনশীলভাবে ব্যবহার করা উচিত। এটি ‘শিল্পের নামে বিদ্বেষ?’ বলেই অনেকেই মনে করেন। এটি এক ধরনের ধর্মীয় জঙ্গিবাদ। এমন একটি প্রদর্শনী ‘শিল্পরুচির প্রশ্ন’ ছাড়িয়ে গিয়েছে এবং সামাজিক ও কূটনৈতিক শিষ্টাচারের ঘোরতর পরিপন্থিী।
সাংবাদিক ও মিডিয়া পর্যালোচনায় প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, এমন একটি প্রতিকৃতি তৈরি করা হয়েছে যে, যেখানে ‘ভিনদেশী’ একজন ব্যক্তি, যিনি বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেন; তাকে ‘অসুর’ বলা হয়েছে। এটি ধর্মীয় বা সাংস্কৃতিক নয় কোনভাবেই। বিতর্ক-নির্বিশেষে রাজনৈতিক এবং এটি সার্বভৌমত্বের উপর প্রবল আঘাত। সীমান্তরেখা অতিক্রমের সমতূল্য। অনেক সংবাদমাধ্যম ও ব্লগে লেখা হয়েছে, এই কাজ শুধুই ব্যক্তির বিরুদ্ধে নয়, এটি বাংলাদেশের প্রতি ভারতের নগ্ন আক্রমণ।
এই ধরনের ঘটনা-যেখানে সাংস্কৃতিক বা ধর্মীয় উৎসব রাজনৈতিক প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়, তা আবশ্যিকভাবে সংবেদনশীল। তাই দুই দেশে সাংস্কৃতিক প্রদর্শন ও উৎসবগুলোর জন্য একটি নৈতিক ও সাংবিধানিক দিকনির্দেশনা থাকা উচিত। বিশেষ করে যেখানে প্রতীক ও রূপক ব্যবহার করা হয়। কূটনৈতিক ও আন্তঃমন্ত্রণালয় সমন্বয় থাকা জরুরি। এই ধরনের ঘটনার আগে বা পরে দুই দেশের বস্তুনিষ্ঠ মীমাংসা ও আলোচনার পথ উন্মুক্ত থাকা আবশ্যক। দুই দেশের সংস্কৃতিমন্ত্রী, কূটনীতিক ও সংশ্লিষ্ট রাজ্য সরকারের মধ্যে যোগাযোগ চুক্তি বা ‘সীলবদ্ধ নীতি’ থাকতে পারে। সীমান্তবর্তী অঞ্চলের মানুষদের সঙ্গে প্রচলিত সংলাপ ও সাংস্কৃতিক বিনিময় বৃদ্ধি করতে হবে। সংবাদ মাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সশ্রদ্ধ ও দায়িত্বশীল প্রচার জরুরি। প্রতিমা নির্মাণ বা শিল্প প্রদর্শন সব সময় স্বাধীন থাকতে পারে, তবে সেই স্বাধীনতা যদি সীমা লঙ্ঘন করে বা আক্রমণাত্মক হয়, তবে সীমাবদ্ধতার নীতি প্রয়োগ করা যেতে পারে। ধর্মীয় মর্মবাণী, জাতিসংঘ বা দুই দেশের আইন ও সংবিধান অনুযায়ী ‘সম্মান ও অমর্যাদার সীমা’ নির্ধারণ করা যেতে পারে।
‘ড. ইউনূসের অসুর’ প্রতিকৃতির ঘটনা শুধু প্রতিমার শিল্প রূপক নয়; নিঃসন্দেহে প্রতীকী সঙ্কট ও কূটনৈতিক শিষ্টাচার বহির্ভুত। এটি দুই দেশের মধ্যে বিদ্যমান আস্থা এবং সন্দেহের সর্বোচ্চ মাত্রা স্পর্শ করেছে। বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক, অতীত ইতিহাস, সংস্কৃতির ওপর গড়ে উঠেছে-তা আজও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই ধরনের ঘটনা যদি নিয়ন্ত্রণ ও সংযমহীনভাবে ব্যবহার হয়, তাহলে তা বন্ধনকে দুর্বল করতে পারে। অতএব সাংস্কৃতিক রীতি ও শৃঙ্খলা, কূটনৈতিক সমন্বয়, স্থানীয় জনসংযোগ ও মাধ্যমিক দায়িত্বশীলতা-এসব নীতি যতো দ্রুত গৃহীত হবে, সম্পর্কের স্থিতি ততো সুরক্ষিত থাকবে। তবে ভারতের অব্যাহত আক্রমণাত্মক আচরণ এবং বাংলাদেশকে ধারাবাহিক অপমান করার যে প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে তাতে এক পক্ষীয় বন্ধুত্ব ধরে রাখার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের প্রাণান্তকর প্রচেষ্টায় বিরতি দেওয়ার সময় এসেছে। এখন তাদের সাথে সম্পর্ক রক্ষার ক্ষেত্রে ইজমা-কিয়াস পদ্ধতি পরিত্যাগ করতে হবে।
লেখক: কলামিস্ট ও রাজনীতি বিশ্লেষক
আরও পড়ুন:








