দশকের পর দশক ধরে ইউরোপ ছিল যুদ্ধ, স্বৈরশাসন ও নির্যাতন থেকে পালিয়ে আসা মানুষের জন্য নিরাপদ আশ্রয়। কিন্তু দিন দিন দেখা যাচ্ছে, যেসব আইন আসলেই দুর্বল ও নির্যাতিতদের রক্ষার জন্য তৈরি হয়েছিল, তা এখন অন্যভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে বিশেষ করে বাংলাদেশি রাজনীতিবিদদের দ্বারা।
শরণার্থী কনভেনশন ও ফাঁকফোকর
১৯৫১ সালের জেনেভা কনভেনশন আসলে জীবন বাঁচানোর জন্য প্রণীত হয়েছিল, কারও রাজনৈতিক সুনাম রক্ষার জন্য নয়। কিন্তু অনেক রাজনীতিবিদের হাতে এটি হয়ে উঠেছে একধরনের সুবিধাজনক পালানোর পথ। দেশে যখন দুর্নীতি, অর্থপাচার বা ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ ওঠে, তখন তারা বিদেশে ছুটে যান এবং দাবি করেন রাজনৈতিক নির্যাতনের শিকার।
ইউরোপীয় আদালতগুলো নন-রিফাউলমেন্ট নীতিতে (অর্থাৎ কাউকে এমন দেশে ফেরত না পাঠানো, যেখানে তার প্রাণনাশের ঝুঁকি আছে) বাধ্য। ফলে, অভিযোগ সত্য বা মিথ্যা যাই হোক, সামান্য ঝুঁকির প্রমাণ পেলেই প্রায়শই তাদের আবেদন মঞ্জুর করা হয়।
ক্ষমতাবানদের জন্য সুবিধা
একবার আশ্রয় পেলে সুবিধা বিপুল— বৈধ বসবাস, বাড়ি ও স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ, এমনকি নাগরিকত্ব পাওয়ার পথ। কিন্তু রাজনীতিবিদদের জন্য সবচেয়ে বড় পুরস্কার হলো দেশে বিচারের মুখোমুখি না হওয়ার সুরক্ষা।
লন্ডন, বার্লিন বা স্টকহোমের মতো নিরাপদ শহরে বসেই তারা আবারও রাজনীতি চালিয়ে যান, প্রায়শই আগের চেয়ে বেশি উচ্চকণ্ঠে। অথচ এই সুবিধা কখনও তাদের জন্য প্রণীত ছিল না। আশ্রয়ের আসল উদ্দেশ্য ছিল নির্যাতিত সাংবাদিক, হুমকির মুখে থাকা সংখ্যালঘু কিংবা নির্যাতনের ভয়ে ভীত মানবাধিকারকর্মীদের রক্ষা করা। যখন ক্ষমতাশালীরা এটিকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেন, তখন গোটা ব্যবস্থার বিশ্বাসযোগ্যতা ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
বাংলাদেশের হতাশা
বাংলাদেশের জন্য এটি বারবার একই অভিজ্ঞতা। প্রত্যর্পণের অনুরোধ প্রায় সব সময়ই ব্যর্থ হয়। ইউরোপীয় আদালতগুলো যুক্তি দেয়, ঢাকার বিচার আন্তর্জাতিক মান পূরণ নাও করতে পারে। ফলে যাদের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে, তারাই বিদেশে আরাম-আয়েশে জীবনযাপন করেন, আর দেশে ভুক্তভোগীরা ন্যায়বিচারের অপেক্ষায় থাকেন। এতে ক্ষোভ বাড়ে। প্রশ্ন ওঠে কোটি টাকার দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্তরা কেন ইউরোপে সুরক্ষা পান, অথচ সাধারণ শরণার্থীরা মৌলিক স্বীকৃতির জন্য লড়াই করেন?
আইন পরিষ্কার
সন্ত্রাস, যুদ্ধাপরাধ বা গুরুতর অপরাধ করলে আশ্রয়ের মর্যাদা বাতিল হতে পারে। কিন্তু দুর্নীতি বা ক্ষমতার অপব্যবহার— যা বাংলাদেশি রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে সাধারণ অভিযোগ— তা এই পর্যায়ে পড়ে না। ফলে, ক্ষমতাবানরাই ভোগ করেন সেই সুরক্ষা, যা মূলত দুর্বলদের জন্য তৈরি হয়েছিল।
ইউরোপের জন্য বড় প্রশ্ন
ইউরোপ গর্ব করে মানবাধিকারের সুরক্ষা নিয়ে। কিন্তু এখন প্রশ্ন জাগে— তারা কি সঠিক মানুষদেরই সুরক্ষা দিচ্ছে? যদি আশ্রয় ব্যবস্থা রাজনৈতিক অভিজাতদের হাতে চলে যায়, তবে জনসমর্থন দুর্বল হয়ে যাবে। আর তখন ভুগবেন প্রকৃত শরণার্থীরাই।
শেষকথা
বাংলাদেশকে তার বিচারব্যবস্থা সংস্কার করতে হবে, যাতে ইউরোপের কাছে আর অজুহাত না থাকে। কিন্তু ইউরোপকেও তার যাচাই প্রক্রিয়াকে কঠোর করতে হবে। নাহলে আশ্রয় ধীরে ধীরে মানবাধিকারের চেয়ে রাজনৈতিক সুবিধার হাতিয়ারে পরিণত হবে একধরনের নিরাপদ প্রস্থান, যাদের কাছে দেশ ছাড়ার টিকিট কেনার সামর্থ্য আছে।
যতদিন না উভয় পক্ষই ব্যবস্থা নেয়, ততদিন শরণার্থী আর পলাতক আসামির সীমারেখা বিপজ্জনকভাবে অস্পষ্টই থেকে যাবে।
আরও পড়ুন:








