বুধবার

১২ নভেম্বর, ২০২৫ ২৮ কার্তিক, ১৪৩২

প্রাথমিকে সঙ্গীত শিক্ষক নিয়োগ, ট্রান্সজেন্ডার কোটা ও প্রজন্ম ধ্বংসের নীলনকশা

কাজী আশফিক রাসেল

প্রকাশিত: ২১ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ১১:৫১

শেয়ার

প্রাথমিকে সঙ্গীত শিক্ষক নিয়োগ, ট্রান্সজেন্ডার কোটা ও প্রজন্ম ধ্বংসের নীলনকশা
কাজী আশফিক রাসেল

শিক্ষা মানুষের মৌলিক অধিকার, আর প্রাথমিক শিক্ষা হলো সেই অধিকার অর্জনের প্রথম ধাপ। একটি জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করে প্রাথমিক শিক্ষার দৃঢ় ভিত্তির ওপর। কিন্তু বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষা আজ নানা সংকটে জর্জরিত। বিভিন্ন জরিপে দেখা গেছে, দেশের লাখ লাখ শিশু পঞ্চম শ্রেণি পেরিয়েও বাংলা পড়তে, অঙ্ক কষতে কিংবা ইংরেজির মৌলিক বর্ণ চিনতে হিমশিম খায়। ফলশ্রুতিতে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়ার হার, জনমানসের অসন্তোষ উদ্বেগ ক্রমশই বাড়ছে। প্রাথমিক বিদ্যালয় বিমুখ হয়ে অনেক অবিভাবক তাদের সন্তাদের মাদ্রাসামুখী করছেন। অবস্থায় সরকারের অগ্রাধিকার হওয়া উচিত ছিল মৌলিক শিক্ষা শক্তিশালী করা, দক্ষ শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া। কিন্তু সেই সংকট সমাধান না করে উল্টো প্রাথমিক স্তরে আলাদা করে সঙ্গীত শিক্ষক নিয়োগের সিদ্ধান্ত ট্রান্সজেন্ডার কোটার উদ্যোগ সমাজে নতুন বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, এই অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্তের উদ্দেশ্য আসলে কী? এটি কি শিক্ষার মানোন্নয়ন, নাকি প্রজন্ম ধ্বংসের নীলনকশা? একটি দেশের শিক্ষানীতি সেদেশের জাতীয় অগ্রগতির পথ নির্ধারণ করে। কারণ আজকের শিশুরাই আগামী দিনের নাগরিক, নেতা নীতিনির্ধারক। তাই প্রাথমিক স্তরে কী পড়ানো হবে, কেমন শিক্ষক নিয়োগ হবে এই প্রশ্ন শুধু শিক্ষার নয়, এটি সরাসরি আমাদের আত্মপরিচয়, ধর্মীয় মূল্যবোধ সামাজিক কাঠামোর প্রশ্ন। সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের পক্ষ থেকে দেশের প্রায় ৬৫ হাজারেরও বেশি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সঙ্গীত শিক্ষক নিয়োগ এবং ট্রান্সজেন্ডার কোটার অন্তর্ভুক্তির যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, তা স্পষ্টই আমাদের জাতীয় ঐতিহ্য সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়কে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করার সুপরিকল্পিত অপচেষ্টা। একই সঙ্গে এটি এদেশের কোটিকোটি ধর্মপ্রাণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে সরাসরি আঘাত হানার শামিল। এর ভেতরে লুকিয়ে আছে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের গভীর ছায়া, তাদের বিদেশি প্রভুদের চাপিয়ে দেওয়া নীতি। আর এই প্রকল্পের সূত্রপাত হয়েছিল পতিত আওয়ামী ফ্যাসিস্ট শাসনামলে। তখন থেকেই এনজিও-নির্ভর কিছু সেক্যুলার গোষ্ঠী শিক্ষাব্যবস্থায় ইসলামবিরোধী ধারা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছিল। দুঃখজনকভাবে আজ অন্তর্বর্তী সরকারের নমনীয়তার সুযোগে সেই পুরোনো নীলনকশা আবারও মাথাচাড়া দিচ্ছে।

প্রাথমিক স্তরে সঙ্গীত অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষে কতিপয় শিক্ষা বিশ্লেষক যুক্তি দেখাচ্ছেন যে, সংগীত শোনার সময় মস্তিষ্কে ডোপামিন নামের রাসায়নিক নিঃসৃত হয়, যা আনন্দ বাড়ায় এবং শেখাকে উপভোগ্য করে। পাশ্চাত্যের দেশগুলো কারণেই সঙ্গীতকে শিক্ষা পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করেছে বলে তারা দাবি করছেন। আর সেই অজুহাতেই তারা বাংলাদেশের প্রাথমিক স্তরেও সঙ্গীত চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু প্রশ্ন হলো, পাশ্চাত্য আর বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট কি এক? পাশ্চাত্যের প্রতিটি দেশেই তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে বিবেচনায় রেখেই সঙ্গীত অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। অথচ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট তো এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ভিন্ন।

এখানে প্রায় ৯২ শতাংশ মানুষ মুসলিম; তাদের বড় অংশই চান সন্তানরা ছোটবেলা থেকেই ধর্মীয় নৈতিক শিক্ষার ভিত্তিতে বেড়ে উঠুক। পশ্চিমা ধাঁচের গান, নৃত্য বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার ইসলামি মূল্যবোধের সাথে স্পষ্টতই সাংঘর্ষিক। এক্ষেত্রে ডোপামিন যুক্তি কতটা টেকসই? আর এই ডোপামিন কি শুধু সঙ্গীতেই নিঃসৃত হয়? এক্ষেত্রে ভুলে যাওয়া উচিত হবে না যে, মুসলমানদের কাছে সর্বশ্রেষ্ঠ সুরের উৎস হলো কোরআন তিলাওয়াত। কোটি কোটি মুসলিম প্রতিদিন কোরআন শুনে যে প্রশান্তি অনুপ্রেরণা পান, তা সঙ্গীতের যেকোনো প্রভাবকেও ছাড়িয়ে যায়। বৈজ্ঞানিক গবেষণায়ও প্রমাণিত হয়েছে, কোরআন তিলাওয়াত মানুষের হৃদয়ে একইভাবে ডোপামিন নিঃসরণ স্নায়ুবিক প্রতিক্রিয়া ঘটায়। তাহলে কেন ৯২ শতাংশ মুসলিম অধ্যুষিত দেশে কোরআন তিলাওয়াতকে শিক্ষায় অগ্রাধিকার দেওয়া হবে না, অথচ বাদ্যযন্ত্র, গান নৃত্যকে চাপিয়ে দেওয়া হবে? এখানেই তথাকথিত প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবীদের দ্বিচারিতা স্পষ্ট হয়। তারা ডোপামিনের যুক্তি দেখান, কিন্তু বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় মূল্যবোধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যকে পদদলিত করে পাশ্চাত্যের দৃষ্টান্তকেই আদর্শ হিসেবে চাপিয়ে দিতে চান। এই চাপিয়ে দেয়া কখনো সুস্থ সংস্কৃতির অংশ হতে পারে না, বরং এটি আমাদের কথিত বুদ্ধিজীবীদের চরম বিদ্বেষমুলক মনোভাব ভয়ংকর উগ্রবাদী মানসিকতার নগ্ন বহিঃপ্রকাশ।

বাস্তবতা হলো, এই প্রকল্পের অন্তরালে কাজ করছে একটি ইসলামবিরোধী শক্তি, যাদের মূল লক্ষ্য বাংলাদেশের মতো মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে সাংস্কৃতিক আগ্রাসন চালানো।

তারা শিক্ষা ব্যবস্থাকে ব্যবহার করে প্রজন্মকে ধর্মহীনতার পথে ঠেলে দিতে চায়। আজ সঙ্গীত, কাল নৃত্য, পরশু এলজিবিটি বিষয় - এই ধারাবাহিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে ইসলামী চেতনা ধ্বংস করার এক সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র চলছে। এর পেছনে রয়েছে কিছু বিদেশি এনজিও, পশ্চিমা অর্থায়ন, উগ্র হিন্দুত্ববাদী আগ্রাসন এবং বিদেশি উচ্ছিষ্টভোগী সেক্যুলার লবি। সঙ্গীত শিক্ষা চালুর নামে হাজার হাজার শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার যে পয়তারা বর্তমানে চলছে, তাতে মূলত কারা নিয়োগ পাবেন? বাস্তবে এদের বড় অংশ হবে ইসলামী মূল্যবোধবিরোধী, অমুসলিম, সেক্যুলার, নাস্তিক, ট্রান্সজেন্ডার এলজিবিটি সমর্থক। তারা কেবল সঙ্গীত শেখাবেন না, বরং কোমলমতি শিশুদের মনোজগতে বিকৃত পশ্চিমা সংস্কৃতি, হিন্দুত্ববাদ নাস্তিকতার বীজ সুকৌশলে রোপণ করবেন। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বিভ্রান্ত করার এই চক্রান্তকে কোনোভাবেই হালকাভাবে দেখা যাবে না। আরও একটি আশ্চর্যজনক বিষয় হলো সরকারি নিয়োগেতৃতীয় লিঙ্গতথা ট্রান্সজেন্ডার কোটার সংযোজন। জন্মগত হিজড়াদের প্রতি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকা উচিত। কিন্তু অস্পষ্ট সংজ্ঞার আড়ালে সমকামী বিকৃত লিঙ্গ ধারণার মানুষদের শিক্ষকতার সুযোগ দেওয়া সরাসরি শিশুদের মনোজগতে বিভ্রান্তি তৈরি করবে। শিশুরা কোমলমতি, তারা যা দেখে সহজেই প্রভাবিত হয়। একবার যদি প্রাথমিক স্তরে ধরনের চরিত্র গড়ে ওঠে, তবে তা পরিবার, সমাজ জাতির ভবিষ্যৎকে বিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দেবে। সমাজে এখনও এই বিষয়ে পর্যাপ্ত সচেতনতা প্রস্তুতি তৈরি হয়নি। সরকারের এমন হীন বিতর্কিত প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে ইসলামিক স্কলার থেকে শুরু করে মাদ্রাসাশিক্ষিতরা জোরেশোরে মাঠে নামলেও, সে তুলনায় সাধারণ শিক্ষিতদের মধ্যে তেমন সরব প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। কারণ সাধারণ মানুষ এখনো পর্যাপ্তভাবে সজাগ নয়। তাদের অনেকেই মনে করছেন, বিষয়টি কেবল চাকরি বা কর্মসংস্থানের প্রশ্ন। অথচ বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। এটি কেবল অর্থনৈতিক ইস্যু নয়; বরং বিশ্বাস, চরিত্র এবং পুরো প্রজন্মকে সঠিক মূল্যবোধে গড়ে তোলার প্রশ্ন। আজ যদি শিক্ষায় সঙ্গীত ট্রান্সজেন্ডার কোটাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়, তবে আগামী দিনে আমাদের সন্তানরা কেমন মানসিকতা নৈতিকতায় বেড়ে উঠবে তা সহজেই অনুমেয়।

আজ আগামীর প্রজন্মকে সুস্থ, সৎ আলোকিত নাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে হলে শিক্ষাব্যবস্থাকে অবশ্যই জাতীয় ঐতিহ্য, ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং মৌলিক শিক্ষার মানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাখতে হবে। বিদেশি প্রভুভক্ত কিছু উচ্ছিষ্টভোগী গোষ্ঠীর চাপিয়ে দেওয়া এজেন্ডা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। উন্নয়ন আধুনিকতার নামে ইসলামী মূল্যবোধকে অস্বীকার করা হলে তা কেবল শিশুদের মানসিক বিভ্রান্তিই সৃষ্টি করবে না; বরং দীর্ঘমেয়াদে জাতীয় সংস্কৃতি পরিচিতিকে ধ্বংস করবে।

তাই শিক্ষানীতিতে যেকোনো পরিবর্তন আনার আগে সমাজের প্রতিটি শ্রেণির মতামতকে মর্যাদা দেওয়া অপরিহার্য। শিশুদের পাঠ্যপুস্তক এমন হতে হবে, যা তাদের আনন্দ দেবে, কিন্তু সেই আনন্দ হবে বিশ্বাস, সংস্কৃতি ধর্মীয় শেকড়ের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ। আমাদের শহীদদের রক্তের ঋণ, জাতীয় ঐতিহ্য ভবিষ্যৎ প্রজন্ম রক্ষার স্বার্থেই পথ থেকে বিচ্যুত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।

লেখকঃ তরুণ কলামিস্ট হিউম্যান রাইটস অ্যাক্টিভিস্ট।

গ্রাজুয়েট শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।



banner close
banner close