বুধবার

১২ নভেম্বর, ২০২৫ ২৮ কার্তিক, ১৪৩২

ডাকসুতে শিবিরের ভূমিধস বিজয় ও ছাত্রদলের ভরাডুবি: নেপথ্যে কী?

কাজী আশফিক রাসেল

প্রকাশিত: ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ১২:১৪

শেয়ার

ডাকসুতে শিবিরের ভূমিধস বিজয় ও ছাত্রদলের ভরাডুবি: নেপথ্যে কী?
কাজী আশফিক রাসেল

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচন ছিল বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ টেস্ট। এই টেস্টে ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলের ভরাডুবি এবং শিবিরের এক প্রকার ভূমিধস বিজয় রাজনৈতিক মহলে গভীর আলোচনার জন্ম দিয়েছে। তবে এই ফল কেবল একটি ছাত্রসংগঠনের জয়-পরাজয়ের হিসাব নয়; এর ভেতর দিয়ে দেশের সামগ্রিক রাজনীতি, তরুণ সমাজের দৃষ্টিভঙ্গি এবং আগামী দিনের রাজনীতির দিকনির্দেশনাও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

প্রথমেই স্বীকার করতে হবে, এদেশে দীর্ঘ সতের বছর ফ্যাসিস্ট আওয়ামী লীগের দুঃশাসনের মধ্যে ছিল। ভারতীয় সেবাদাসী হাসিনা সরকারের প্রধান কৌশল ছিল ভারতীয় -এর প্রেসক্রিপশন মেনে বিরোধী মতকে দমন করা। এজন্য তারা ট্যাগিং সংস্কৃতির আশ্রয় নেয়। ধর্মপ্রাণ মুসলিম বিরোধীদের কখনো রাজাকার, কখনো পাকিস্তানি দোসর, কখনো মৌলবাদী বা জঙ্গি আখ্যা দিয়ে হয়রানি করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার নামে এই ট্যাগিং মূলত ছিল ভারতীয় ন্যারেটিভের কপি।

২০২৪ সালের জুলাই অভ্যুত্থানের পর মানুষ ভেবেছিল, বাংলাদেশ নতুন সূর্যের পথে হাঁটবে, এই ট্যাগিং রাজনীতি চিরতরে বিলুপ্ত হবে। কিন্তু বাংলাদেশের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রপতি শহীদ জিয়াউর রহমানের হাতে প্রতিষ্ঠিত, আপোষহীন নেত্রী সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে দীর্ঘ গণতান্ত্রিক সংগ্রামের পথ পাড়ি দেওয়া বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি যখন প্রতিদ্বন্দ্বীকে রাজাকার বা মৌলবাদী আখ্যা দিতে শুরু করল, তখন মানুষ বিভ্রান্ত হলো।

দেশের প্রায় ৯৫ শতাংশ মানুষ প্রচন্ডভাবে ভারতীয় আগ্রাসনবিরোধী। ২০১৪ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত ভোটারবিহীন জাতীয় নির্বাচনগুলোর অভিজ্ঞতাই প্রমাণ করে, ভারতপন্থী রাজনীতির প্রতি মানুষের আস্থা শূন্যের কোঠায় নেমেছে। তাই ভারতীয় ন্যারেটিভ ব্যবহার করে মানুষের মন জয় করা কেবল অসম্ভবই নয়, রাজনৈতিক আত্মঘাতীও বটে। এদেশের মানুষ আজ দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করে, যে মানুষ যত বেশি ভারতবিরোধী, সে ততটাই দেশপ্রেমিক। দলীয়ভাবে বিএনপি জামায়াত-শিবিরের বিরুদ্ধে যে বয়ান হাজির করেছে, সেটি মূলত আওয়ামী লীগের পুরোনো অস্ত্র। এর ফল হয়েছে উল্টো মানুষের ভেতর ক্ষোভের বিস্ফোরণ।

এবারের ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদলের প্রায় সবপ্রার্থীরই ব্যক্তিগত ইমেজ ছিলো তুলনামূলকভাবে পরিষ্কার জনপ্রিয়। তবুও তারা ব্যর্থ হয়েছে। এর মূল কারণ, তাদের রাজনৈতিক বয়ান তরুণ সমাজকে আকর্ষণ করতে পারেনি। প্রতিপক্ষ দলগুলোর নেতিবাচক বয়ান খণ্ডন করতে তারা পারেনি, আবার নিজেদের পক্ষেও সময়োপযোগী কোনো ইতিবাচক বয়ান দাঁড় করাতে ব্যর্থ হয়েছে। ফলে প্রার্থীদের পরিছন্ন ভাবমূর্তি সত্ত্বেও ছাত্রদলের বড় ধরণের ভরাডুবি হয়েছে।

রাজনীতির মাঠে প্রতিযোগিতা অবশ্যই থাকবে, তবে প্রতিযোগিতা হতে হবে উপযুক্ত ন্যারেটিভ দিয়ে। প্রতিপক্ষকে হেয় করার জন্য পতিত আওয়ামী ন্যারেটিভ ধার করলে তা শেষ পর্যন্ত নিজেদের বিরুদ্ধে গিয়েই দাঁড়াবে যা ডাকসু নির্বাচনে খুব ভালোভাবেই প্রমাণিত হয়েছে

শিক্ষাঙ্গনের বাস্তবতা এখানে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। দীর্ঘ ফ্যাসিস্ট শাসনের কবল থেকে উচ্চশিক্ষার দুর্গগুলোও মুক্ত ছিল না। বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলো কার্যত ছাত্রলীগকে ইজারা দেওয়া হয়েছিল। নিম্ন নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা শিক্ষার্থীরা আবাসনের জন্য বাধ্য হয়ে তাদের কর্মসূচিতে অংশ নিত। এর দায় বর্তমান প্রজন্মের নয়, বরং পূর্ববর্তী প্রজন্মের, যারা প্রতিরোধের মশাল জ্বালাতে ব্যর্থ হয়েছিল। তবে একই সঙ্গে এটাও সত্য, এই প্রজন্মই আবার প্রতিরোধের শিখা জ্বালিয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানসহ নানা আন্দোলনে তারাই জ্বালানি জুগিয়েছে। এক্ষেত্রেও একটি গুরুতর ভুল করেছে বিএনপি ছাত্রদল।ছাত্রলীগের লুঙ্গির নিচে বড় হওয়া প্রজন্মবলে তরুণদের হেয় করার প্রবণতাও তাদের মধ্যে দেখা গেছে। এটি শুধু অবিচার নয়, ছাত্রসমাজের প্রতি অবমাননা। যারা বাস্তবে দমননীতির বিরুদ্ধে লড়েছে, তাদেরকে অবজ্ঞা করলে তারা আর আস্থা দেবে কেন? ট্যাগিংয়ের এই রাজনীতি শেষ পর্যন্ত ক্ষোভ বিচ্ছিন্নতাই তৈরি করে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষণে আরেকটি বিষয় গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপির বিরুদ্ধে যে ন্যারেটিভ জনমনে দৃঢ়ভাবে গেঁথে গেছে তা হলো, এটিচাঁদাবাজি, দখল লুটপাটের দল”, যাদের রাজনীতি আওয়ামী লীগের প্রতিরূপ মাত্র। এই বয়ান কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নয়, সারাদেশের তরুণ সমাজ সাধারণ ভোটারের মধ্যেও ছড়িয়ে আছে। বিএনপি এই বয়ান খণ্ডন করতে পারেনি, আবার নতুন কোনো ইতিবাচক ন্যারেটিভও হাজির করতে পারেনি। এর বিপরীতে জামায়াত-শিবির নিজেদের একটি বিকল্প চিত্র দাঁড় করাতে পেরেছে।

প্রেক্ষাপটে বিএনপি ছাত্রদলের জন্য জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে আত্মশুদ্ধি অভিযান। বিতর্কিত ব্যক্তিদের ছত্রছায়া দেয়া নয়, বরং তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা দরকার। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের বয়ান খণ্ডন করা যেমন জরুরি, তেমনি নিজেদের পক্ষ থেকেও সময়োপযোগী রাজনৈতিক বয়ান তৈরি করে তরুণদের আস্থা অর্জন করা এখন সময়ের দাবি।

সত্য হলো, আমাদের তরুণ সমাজ আর বিভাজনমূলক রাজনীতি চায় না। তারা দেখতে চায় ইতিবাচক প্রতিযোগিতা। কোন দল কতটা উন্নত নীতি উপস্থাপন করতে পারে, জনগণের কাছে কতটা আস্থার বার্তা পৌঁছে দিতে পারে, সে প্রতিযোগিতা হওয়া দরকার। সংসদ থেকে শুরু করে ওয়ার্ড পর্যায় পর্যন্ত রাজনীতির মূল বক্তব্য হওয়া উচিত উন্নয়নের পরিকল্পনা, স্বচ্ছতা, আত্মত্যাগের মানসিকতা।

ডাকসুর এই ফলাফল কেবল ছাত্রদলের ব্যর্থতা বা শিবিরের সাফল্য নয়; এটি বাংলাদেশের মূলধারার রাজনীতির জন্য একটি আয়না। জনগণ দেখিয়ে দিয়েছে, পতিত আওয়ামী লীগের ন্যারেটিভ ধার করলে হবে না, জনগণ নতুন চিন্তা, নতুন দৃষ্টিভঙ্গি চায়। বিএনপি ছাত্রদল যদি আওয়ামী লীগের পুরোনো কৌশল ধার করে, তবে তাদের সামনে একই পরিণতি অপেক্ষা করছে। কিন্তু যদি তারা নিজেদের ভুল থেকে শিক্ষা নেয়, নতুন ন্যারেটিভ দাঁড় করায় এবং অভ্যন্তরীণ সংস্কার ঘটায়, তবে ভবিষ্যতের রাজনীতিতে আবারও তারা নেতৃত্ব দাবি করতে পারবে।

লেখকঃ তরুণ কলামিস্ট হিউম্যান রাইটস অ্যাক্টিভিস্ট।

গ্রাজুয়েট শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।



banner close
banner close