বুধবার

১২ নভেম্বর, ২০২৫ ২৮ কার্তিক, ১৪৩২

ডাকসু নির্বাচনের সেকাল-একাল, ঝুঁকি মোকাবেলায় থাকতে হবে তৎপর

অনিরুদ্ধ অনিকেত 

প্রকাশিত: ৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ ২১:৪৪

শেয়ার

ডাকসু নির্বাচনের সেকাল-একাল, ঝুঁকি মোকাবেলায় থাকতে হবে তৎপর
ডাকসু নির্বাচনের সেকাল-একাল

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) বাংলাদেশের ছাত্ররাজনীতির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান। সাথে সাথে এই নির্বাচন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিতে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং সংবেদনশীল-ও বটে। এটি শুধু একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসংসদ নয়, বরং পুরো দেশের রাজনীতির এক শক্তিশালী প্রতিচ্ছবি। এমনকি এবারের রাজনৈতিক প্রতিযোগিতা দেখে মনে হচ্ছে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের একটি রিহার্সেল। স্বাধীনতার আগে ও পরে ডাকসুর নির্বাচিত নেতৃত্ব জাতীয় রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। অসংখ্য ঐতিহাসিক আন্দোলনের সূতিকাগার হিসেবে ডাকসু অমর হয়ে আছে। বাংলাদেশের রাজনীতির ল্যাবরেটোরি হচ্ছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু দীর্ঘ বিরতির পর ২০১৯ সালে ডাকসুর নির্বাচন যখন অনুষ্ঠিত হলো, তখন সেটি নিয়ে দেখা দিলো নানা বিতর্ক ও অনিয়মের অভিযোগ। তবে রাত পোহালেই এবারের ডাকসু নির্বাচন। এটি জাতীয় নির্বাচন না হলেও এই নির্বচনকে কেন্দ্র করে জাতীয় টেনশন দৃশ্যমান। তাই এবারের নির্বাচন প্রশ্নে ছাত্রসমাজ যেমন আশাবাদী, তেমনি শঙ্কিতও। ডাকসুর সে-কালের ভূমিকা, এ-কালের সংকট এবং ভবিষ্যতের ঝুঁকি ও সম্ভাবনা নিয়ে এখনই ভাবনার উৎকৃষ্ট সময়। প্রতিযোগিতা যেন প্রতিহিংসা না হয়, সেদিকে দৃষ্টি দেওয়া সংশ্লিষ্টদের একান্ত কর্তব্য বলেই বিবেচিত।

ডাকসুর সূচনা ও সে-কালের প্রেক্ষাপট

১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯২২ সাল থেকেই শিক্ষার্থীরা সংগঠিত হয়ে নিজেদের অধিকার ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জন্য একটি প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে। পরে সেটিই ডাকসু নামে পরিচিত হয়। প্রথম দিকে ডাকসু মূলত সাংস্কৃতিক, খেলাধুলা ও শিক্ষার্থীদের কল্যাণকেন্দ্রিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করলেও ধীরে ধীরে এটি রাজনৈতিক চেতনার জন্মভূমি হয়ে ওঠে। স্বাধীনতা-উত্তর কালে ডাকসুর ভূমিকা ছিলো গৌরবান্বিত। ভাষা আন্দোলন, গণঅভ্যুত্থান ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম কেন্দ্রবিন্দু ছিলো, তেমনি স্বাধীনতার পরও বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তবে স্বাধীনতার পর ডাকসুর ভূমিকা সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তিত হয়েছে।

ভাষা আন্দোলন-মুক্তিযুদ্ধ ও ডাকসু

১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকার যখন উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার ঘোষণা দেয়, তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ডাকসুর ব্যানারে প্রতিবাদ শুরু করে। এ সময় ১৯৪৭-৪৮ সালে ডাকসুর নির্বাচিত ভিপি অরবিন্দ বসু এবং জিএস অধ্যাপক গোলাম আযম ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। অর্থাৎ, ডাকসুর তৎকালীন নেতারা ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। সালাম, রফিক, বরকত, জব্বারের মতো শহীদদের রক্তে রাজপথ ভিজে যায়। বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস তখন আন্দোলনের মূল ঘাঁটি। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে ডাকসু তাই চিরস্মরণীয়। ১৯৬০ ও ৭০-এর দশকে ডাকসুর নির্বাচিত ছাত্রনেতারা স্বাধীনতার আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা কর্মসূচি বাস্তবায়নে ছাত্রসমাজ এগিয়ে আসে। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে ডাকসু নেতা তোফায়েল আহমেদ, আ স ম আবদুর রবসহ অনেকেই জাতিকে দিকনির্দেশনা দেন। স্বাধীনতার যুদ্ধ শুরু হলে ডাকসুর নেতারা সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।

স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন

স্বাধীনতার পরেও ডাকসুর নেতৃত্ব বারবার জাতীয় রাজনীতিতে প্রভাব ফেলেছে। বিশেষ করে ৮০’র দশকে হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র আন্দোলন গড়ে ওঠে ডাকসুকে কেন্দ্র করে। শহীদ নূর হোসেনের আত্মাহুতি, ১৯৮৭-৯০ সালের ধারাবাহিক আন্দোলন-সবকিছুতে ডাকসু কার্যকর ভূমিকা রেখেছিল। অবশেষে ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদ পতনের পর গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠায় ডাকসুর অবদান অপরিসীম। হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ৮০’র দশকে ডাকসুর ছাত্রনেতারা সম্মিলিত আন্দোলন গড়ে তোলেন। নূর হোসেনের আত্মাহুতি, ১৯৮৭ সালের নভেম্বরের আন্দোলন, ১৯৯০ সালের স্বৈরাচারবিরোধী সংগ্রামে ডাকসুর নেতারা ছিলেন অগ্রণী। অনেক ডাকসু নেতা পরে জাতীয় রাজনীতিতে প্রধান নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন।

এ-কালের ডাকসু নির্বাচন

১৯৯০ সালের পর দীর্ঘ ২৮ বছর ডাকসু নির্বাচন আর হয়নি। ফলে একটি প্রজন্ম নেতৃত্ববিহীন থেকে যায়। ছাত্ররা বারবার ডাকসু নির্বাচনের দাবি তুললেও তা পূর্ণ হয়নি। অবশেষে ২০১৯ সালের ১১ মার্চ ডাকসু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্ররা ভেবেছিল এই নির্বাচন হবে ইতিহাসে মাইলফলক। কিন্তু বাস্তব চিত্র ভিন্ন ছিলো। স্বৈরাচার আওয়ামীলগ সরকারের নজীরবিহীন হস্তক্ষেপের কারণে ভোটকেন্দ্রে ব্যালট বাক্স ভর্তি পাওয়া যায়, অনেক শিক্ষার্থী ভোট দিতে পারেনি, ভোট গণনা নিয়ে অসংখ্য প্রশ্ন ওঠে। ক্ষমতাসীন দলের প্রভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে। নির্বাচনে সহ-সভাপতি (ভিপি) হিসেবে নুরুল হক নূর নির্বাচিত হলেও বাকি বেশিরভাগ পদে জয়ী হয় ছাত্রলীগ। বিরোধী সংগঠনগুলো নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করে এবং অনিয়মের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। শিক্ষার্থীরা আশা করেছিল এই নির্বাচন ছাত্রসমাজকে নতুন নেতৃত্ব দেবে। কিন্তু নির্বাচনে অনিয়ম, কেন্দ্র দখল, ব্যালট বাক্স পূর্ণ অবস্থায় পাওয়া, প্রশাসনের পক্ষপাতিত্বের অভিযোগে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ। নির্বাচন-পরবর্তী সময়ে ছাত্র সমাজের মধ্যে হতাশা দেখা দেয়, ডাকসুর মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়। এতে করে শিক্ষার্থীদের মাঝে ডাকু নিয়ে আস্থার সংকট সৃষ্টি হয়। ২০১৯ সালের অভিজ্ঞতার কারণে শিক্ষার্থীদের মধ্যে আস্থাহীনতা তৈরি হয়। অনেকে মনে করেন, ডাকসু আজ আর শিক্ষার্থীদের অধিকার রক্ষার জায়গা নয়, বরং দলীয় রাজনীতির শাখা। এ কারণে অনেকেই হতাশ হয়ে পড়ে। কিন্তু বর্তমান অন্তবর্তী সরকারের ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ডাকসু ৯ সেপ্টম্বর নির্বাচন হতে যাচ্ছে।

ডাকসু নির্বাচনে এবারের ঝুঁকি

রাজনৈতিক প্রভাব-সহিংসতা এবং পতিত স্বৈরাচারের পালিত দালালগণ স্যাবোটাজ করতে পারে। এতদ্ব্যতীত ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ ও এদেশীয় ‘র’ এর এজেন্টগণ নির্বাচনে সহিংসতা করতে পারে। এছাড়াও বাংলাদেশে ছাত্ররাজনীতি দলীয় রাজনীতির সঙ্গে সরাসরি সংযুক্ত। ফলে ডাকসু নির্বাচনে দলীয় প্রভাব বিস্তার ঘটবে। এর ফলে সহিংসতা, সংঘর্ষ ও প্রাণহানির ঝুঁকি রয়েছে। ২০১৯ সালের মতো না হলেও নির্বাচনে অনিয়মের আশঙ্কা প্রবল। ব্যালট বাক্স দখল, ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শন, ভোটকেন্দ্র নিয়ন্ত্রণ-এসব যদি হয়, তবে নির্বাচন আবারও প্রশ্নবিদ্ধ হবে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি নিরপেক্ষ না থাকে, তবে নির্বাচন নিয়ে আস্থার সংকট দেখা দেবে। অনেক সময় প্রশাসন ক্ষমতাসীন দলের পক্ষে কাজ করে। এমন অভিযোগ ছাত্রদের মধ্যে বিদ্যমান। তবে আশার কথা হলো বিএনপি-জামায়াত সমর্থিত কোন শিক্ষকই কোন হস্তক্ষেপ না করাতে নির্বাচনের পরিবেশ এখনো পর্যন্ত চমৎকার আছে। তবে অনেক সময় ডাকসু নির্বাচন সাধারণত উত্তেজনা ও আন্দোলনের জন্ম দেয়। এতে ক্যাম্পাসে শিক্ষার পরিবেশ ব্যাহত হয়, ক্লাস-পরীক্ষা স্থগিত হয়, এমনকি কখনও কখনও সেশনজটও তৈরি হয়। মাঝে মাঝে ব্যাপক দলীয় প্রভাবের কারণে ছাত্রসমাজ বিভক্ত হয়ে পড়ে। একদিকে প্রকাশ্য জনপ্রিয় ছাত্রদল, অন্যদিকে চুপচাপ জনপ্রিয় শিবির, আবার বামধারার বিভিন্ন সংগঠন। ফলে শিক্ষার্থীদের মধ্যে ঐক্য বিনষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

ডাকসু নির্বাচনের ইতিবাচক সম্ভাবনা

স্বাধীনতা-উত্তর কালে ডাকসু কখনও জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছে, কখনও স্বৈরাচার-বিরোধী আন্দোলনের কেন্দ্রে থেকেছে, আবার কখনও দীর্ঘ সময় অকার্যকর থেকেছে। ১৯৭১-১৯৯০ পর্যন্ত ডাকসু ছাত্র রাজনীতিকে গতিশীল করেছে, কিন্তু ১৯৯০ পরবর্তী সময়ে ডাকসুর স্থবিরতা ছাত্রসমাজকে হতাশ করেছে। তাই ভবিষ্যতে ডাকসু নির্বাচন নিয়মিত, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হলে আবারও এটি জাতীয় নেতৃত্ব তৈরির অন্যতম প্ল্যাটফর্ম হতে পারে। তাছাড়া কিছু কিছু ঝুঁকি থাকলেও ডাকসু নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ। কারণ-এটি ছাত্রদের নেতৃত্ব গড়ে তোলে। শিক্ষার্থীরা নিজেদের সমস্যা তুলে ধরতে পারে। গণতান্ত্রিক চর্চা ও অংশগ্রহণের সুযোগ তৈরি হয়। নতুন প্রজন্মের নেতারা জাতীয় নেতৃত্বে উঠে আসার সুযোগ পায়। ছাত্রদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি পায়।

সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য করণীয়

সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য নির্বাচন পর্যবেক্ষক কমিশন গঠন প্রয়োজন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, প্রাক্তন বিচারপতি, সমাজের নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়ে কমিশন হতে পারে। প্রযুক্তির সর্বোচ্চ ব্যবহার করলে অনিয়ম কমানো সম্ভব। ক্যাম্পাসে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। নির্বাচনকালে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে নিরপেক্ষ রাখতে হবে। ভোটারদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। ছাত্রসংগঠনগুলোর জন্য সমান সুযোগ থাকতে হবে। প্রশাসনের সর্বাবস্থায় নিরপেক্ষ ভূমিকা কাম্য। কোনোভাবেই দলীয় চাপে নত হওয়া যাবে না।

ডাকসু নির্বাচন কেবল একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচন নয়; এটি বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ভবিষ্যতের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। সে-কালের ডাকসু আমাদের দিয়েছে মাতৃভাষার অধিকার, দেশের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগের শহিদি শিক্ষা, মুক্তিযোদ্ধা ও স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনের সাহসী নেতাদের। এ-কালের ডাকসু নানা সংকট ও অনিয়মে জর্জরিত হলেও এর গুরুত্ব এখনও অপরিসীম। এবার যদি ডাকসু নির্বাচন হয়, তবে এর সঙ্গে ঝুঁকি থাকবে রাজনৈতিক প্রভাব, সহিংসতা ও অনিয়মের। কিন্তু সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হলে ছাত্রসমাজের আস্থা ফিরবে, নতুন নেতৃত্ব গড়ে উঠবে, এবং গণতান্ত্রিক চর্চা শক্তিশালী হবে। তাই ডাকসু নির্বাচনকে কেবল আনুষ্ঠানিকতা নয়, বরং ছাত্রসমাজের প্রকৃত অধিকার ও গণতন্ত্রের অনুশীলন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।

লেখক: কলামিস্ট ও রাজনীতি বিশ্লেষক



banner close
banner close