ঘন কালো অন্ধকারে নিমজ্জিত বাংলাদেশ! সামনের পথ আরো কঠিন! আরো অন্ধকার, আরো আশংকার পদধ্বনি শোনা যাচ্ছে। আলোর পথে উত্তরণের পথ খুঁজতে হবে রাজনীতির মাধ্যমেই। জনগণের ম্যান্ডেটের মাধ্যমেই। একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের মাধ্যমেই। এর বিকল্প মানেই অশান্তি। প্রেসক্রাইব্ড বিশৃঙ্খলা। ফলাফল- জনজীবন নিরাপত্তাহীন। সর্বত্র হানাহানি-মারামারি, ছিনতাই-চাঁদাবাজি, দখলবাজি। সবশেষে স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বের উপর মারাত্মক আক্রমণ।
বাংলাদেশ স্বাধীনতার অর্ধশতাব্দী পেরিয়ে বিশ্বের অন্যতম সম্ভাবনাময় রাষ্ট্র হওয়া সত্ত্বেও শুধু রাজনৈতিক-প্রশাসনিক দুর্বৃত্তায়ন ও দুর্নীতির কারণে জনগণের ভাগ্যের বদল হয় নি। তবে পদ্মা সেতুর মতো অবকাঠামোগত সাফল্য, তথ্যপ্রযুক্তি খাতে উন্নতি এবং কৃষি উৎপাদনে স্বনির্ভরতা আমাদের জাতিকে এগিয়ে নিচ্ছে। কিন্তু একইসঙ্গে বাংলাদেশ নানা ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক সংকট, সামাজিক ও রাষ্ট্রীক বৈষম্য, সর্বগ্রাসী দুর্নীতি, জলবায়ু পরিবর্তন এবং আন্তর্জাতিক চাপের মতো কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।
রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণ
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে আস্থার সংকট বিরাজ করছে। এর সবচেয়ে বড় কারণ, গণতন্ত্রহীনতা ও ফ্যাসিবাদী শাসন ব্যবস্থার নিকৃষ্টতম প্রয়োগ। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক, বিরোধী দলের ওপর দমননীতি, দলীয় সহিংসতা এবং প্রশাসনের ওপর রাজনৈতিক প্রভাব গণতান্ত্রিক কাঠামোকে দুর্বল করে তুলেছে। এর ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে হতাশা জন্ম নিচ্ছে, আর বিদেশি দাতাগোষ্ঠী-পর্যবেক্ষকরাও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। তবে একটি স্বচ্ছ, নিরপেক্ষ, পেশীশক্তি প্রয়োগহীন ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন ব্যবস্থা গড়ে তোলা অপরিহার্য। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সহনশীলতা ও সংলাপ সংস্কৃতি তৈরি করতে হবে। পরমত সহিষ্ণুতার কালচার গড়ে তুলতে হবে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। গণমাধ্যম ও সুশীল সমাজকে রাজনৈতিক ভারসাম্য রক্ষায় স্বাধীনভাবে কাজ করার পরিবেশ তৈরি করতে হবে; যার মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় স্থিতিশীলতা আসতে পারে।
অর্থনৈতিক সংকট ভয়ংকর রূপ নিচ্ছে
বাংলাদেশের অর্থনীতি সাম্প্রতিক বছরগুলোতে প্রবৃদ্ধির জন্য প্রশংসিত হলেও বর্তমানে বহুমুখী সংকটে নিপতিত। বিদেশী বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশ বিনিয়োগে নিরাপদ বোধ করছে না। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে গেছে, ডলার সংকট তৈরি হয়েছে, মূল্যস্ফীতি বেড়েছে এবং ব্যাংক খাত অনিয়মে জর্জরিত। গার্মেন্টস খাত এখনো রপ্তানির প্রধান ভরসা হলেও বহুমুখীকরণের অভাব অর্থনীতিকে ঝুঁকিতে ফেলছে। দেশীয় পণ্যের দামও ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। ক্রয়ক্ষমতা ক্রমশ সংকুচিত হচ্ছে। ফলে অন্তর্বর্তী সরকারের ব্যর্থতা ঐতিহাসিক রূপ নিচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনতে হবে। তথ্যপ্রযুক্তি, কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য, শিল্প ও পোশাক খাত, ওষুধ এবং জাহাজ শিল্পের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে হবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য সহজ ঋণ সুবিধা, ঋণপ্রাপ্তি ও দক্ষতা উন্নয়ন জরুরি। ব্যাংক খাতকে দুর্নীতি ও অনিয়ম থেকে মুক্ত করতে হবে। বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণে স্বচ্ছ নীতি ও ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে হবে।
সামাজিক সমস্যা ও সম্ভাবনা
শিক্ষাব্যবস্থায় বৈষম্য, বেকারত্ব, স্বাস্থ্যসেবার ব্যয়বহুলতা, মাদক ও সামাজিক অবক্ষয় আজকের বাংলাদেশে বড় চ্যালেঞ্জ। তরুণ সমাজের মধ্যে হতাশা বাড়ছে, যা মেধা পাচারকে ত্বরান্বিত করছে। তবে জনসংখ্যার বড় অংশ তরুণ হওয়ায় এটিকে ‘ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’ হিসেবেও কাজে লাগানো সম্ভব। বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি 'ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’-কাল পার করছে। 'ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’ চীনসহ অপরাপর রাষ্ট্র উন্নতির চরম শিখরে উঠেছে। কিন্তু ' ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড’-এর সুফল আমরা কাজে লাগাতে পারছি না। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড কাজে লাগাতে শিক্ষার মানোন্নয়ন ও কারিগরি প্রশিক্ষণের ওপর আরো গুরুত্বারোপ করতে হবে। স্বাস্থ্যসেবা সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী করতে সরকারি বরাদ্দ বাড়াতে হবে। কোম্পানির টাকা ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সাথে অবৈধ সম্পর্ক ও লভ্যাংশ প্রাপ্তির বেড়াজালে স্বাস্থ্যসেবা যেন জিম্মি না হয় সেজন্য যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তরুণদের উদ্যোক্তা হতে উৎসাহিত করতে ইনকিউবেশন সেন্টার, স্টার্টআপ ফান্ড ও প্রযুক্তি সহায়তা প্রদান করতে হবে। সামাজিক সচেতনতা ও আইনশৃঙ্খলা জোরদার করে মাদক ও অপরাধ দমন করতে হবে।
দুর্নীতি ও সুশাসন
দুর্নীতি বাংলাদেশের উন্নয়নের সবচেয়ে বড় অন্তরায়। সরকারি প্রকল্পে অতিরিক্ত ব্যয়, টেন্ডারবাজি, ঘুষ সংস্কৃতি এবং দায়মুক্তির প্রবণতা জনগণের আস্থা নষ্ট করছে। বড় বড় দুর্নীতিবাজকে আড়াল করে ছোট খাটো দুর্নীতি দমন করে বাংলাদেশকে দুর্নীতি মুক্ত করা যাবে না। ক্ষমতাশালী দুর্নীতিবাজদের নির্মূল করতে পারলেই এই দেশে সততা আসবে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনকে স্বাধীন ও কার্যকরভাবে কাজ করার সুযোগ দিতে হবে। দুর্নীতি দমন কমিশনকে নিজস্ব জনবল দিয়েই চালাতে হবে। সেখানে প্রশাসন ক্যাডারের দৌরাত্ম বন্ধ করতে হবে। দুদকে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তারা তাদের নিজ ক্যাডারের দুর্নীতি আড়াল এবং সেফগার্ড হিসেবে কাজ করেন। ই-গভর্নেন্স চালু করে প্রশাসনিক কার্যক্রম স্বচ্ছ করতে হবে। দুর্নীতির বিরুদ্ধে আইনের প্রয়োগে কোনো ব্যতিক্রম রাখা যাবে না। জনগণের অংশগ্রহণ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে।
পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন
বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বিশ্বে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, অতিবৃষ্টি-অনাবৃষ্টি, নদীভাঙন, লবণাক্ততা বৃদ্ধি এবং কৃষি উৎপাদনে বিঘ্নিত হওয়া আমাদের জীবনের অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। পরিবেশ বাঁচাতে হলে নবায়নযোগ্য জ্বালানি (সৌর, বায়ু) ব্যবহারে জোর দিতে হবে। টেকসই কৃষি পদ্ধতি ও খরা সহনশীল ফসলের ব্যবহার বাড়াতে হবে। উপকূলীয় এলাকায় ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র ও বন্যা প্রতিরোধক বাঁধ জোরদার করতে হবে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জলবায়ু ক্ষতিপূরণ আদায়ে কূটনৈতিক চাপ অব্যাহত রাখতে হবে।
আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট
ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান বিবেচনায় বাংলাদেশের জন্য একদিকে সুযোগ, অন্যদিকে চ্যালেঞ্জ। ভারত, চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব মোকাবিলা করে একটি ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করতে হচ্ছে। একইসঙ্গে রোহিঙ্গা সংকট এখনো অমীমাংসিত থেকে গেছে। দীর্ঘ সতেরো বছর ফ্যাসিবাদী শাসনের পর এখনো পর্যন্ত একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করা যায়নি। এতে করে জনগণের ক্ষোভ ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাই নিরপেক্ষ ও ভারসাম্যপূর্ণ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করা প্রয়োজন। আঞ্চলিক জোটের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সহযোগিতা বাড়াতে হবে। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ওপর চাপ সৃষ্টি অব্যাহত রাখতে হবে। প্রবাসী শ্রমিকদের অধিকার রক্ষা এবং নতুন শ্রমবাজার খোঁজার পদক্ষেপ নিতে হবে। ঘোষিত সময়ের মধ্যে একটি গ্রহণযোগ্য, নিরপেক্ষ, স্বচ্ছ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজন করতে হবে।
বাংলাদেশের বর্তমান চ্যালেঞ্জগুলো জটিল হলেও তা মোকাবেলা অসম্ভব নয়। রাজনৈতিক সদিচ্ছা, অর্থনৈতিক পরিকল্পনা, সামাজিক সচেতনতা এবং আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রেখে এগুলো মোকাবিলা করা সম্ভব। স্বাধীনতার ৫৪ বছর পর এখন সময় এসেছে একটি দীর্ঘমেয়াদি রূপরেখা তৈরি করার, যেখানে সুশাসন, ন্যায়বিচার এবং টেকসই উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে আজকের সিদ্ধান্তের ওপর। যদি আমরা সাহসী, স্বচ্ছ এবং অংশগ্রহণমূলক নীতি গ্রহণ করতে পারি, তবে বাংলাদেশ কেবল দক্ষিণ এশিয়ায় নয়, পুরো বিশ্বেই উদাহরণ হয়ে উঠতে পারবে।
লেখক: বিশ্লেষক ও কলামিস্ট
আরও পড়ুন:








