
একটি মিথ্যাকে বারবার সত্য হিসেবে প্রচার করতে থাকলে এক সময় মিথ্যাটি সত্য হয়ে যায়। এমন পরিকল্পিত মিথ্যাচার বারবার প্রচার করে ভারতীয় মিডিয়া ভাঁড়ামো, গুজব ও মিথ্যাচারের প্রতীকে পরিণত হয়েছে। বর্তমান বিশ্বের গণমাধ্যম শক্তিশালী এক অস্ত্র। বিশেষ করে ভারতীয় গণমাধ্যম- টেলিভিশন, অনলাইন নিউজ পোর্টাল এবং ইউটিউব ভিত্তিক সংবাদ চ্যানেলসমূহ অনেক সময় প্রতিবেশী দেশগুলো সম্পর্কে পুরাদস্তুর অপপ্রচার চালাচ্ছে। পাকিস্তানের ক্ষেত্রে এমন ঘটনা ঘটালে পাকিস্তান ড্রোন হামলা চালিয়ে তার জবাব দেয়। কিন্তু নির্বিবাদী শান্তিকামী বাংলাদেশ সামরিক পদক্ষেপ নেয় না। যে কারণে বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ভারতের এই হীনপ্রবণতা আরও বেশি লক্ষণীয়। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত, গুজব, বিকৃত তথ্য পরিবেশন, ইতিহাস বিকৃতি ও উস্কানিমূলক খবরের মাধ্যমে ভারতীয় মিডিয়া বহুবার বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের চেষ্টা করেছে এবং করছে। ভারতীয় মিডিয়ার এই সব গুজব বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি ও পররাষ্ট্রনীতিতে প্রভাব ফেলছে এবং এর মোকাবিলায় বাংলাদেশের করণীয় কী হতে পারে, তার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়ন প্রয়োজন।
ভারতীয় মিডিয়ার গুজবের প্রকৃতি ও ধরন:
ভারতীয় মিডিয়ার একটি বড় অংশ স্পষ্টভাবে পক্ষপাতদুষ্ট। অনেক ক্ষেত্রেই তারা হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দলের (বিশেষ করে বিজেপি) আদর্শ প্রচারের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই মিডিয়াগুলো বাংলাদেশের বিষয়ে যেসব গুজব ছড়ায়, তার মধ্যে কয়েকটি প্রধান বিষয় হলো:
রাজনৈতিক অপপ্রচার:
বাংলাদেশের সরকার বা বিরোধী দলের সঙ্গে পাকিস্তানের সম্পর্ক নিয়ে নানা মনগড়া কাহিনী তৈরি করে। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-সহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে বাংলাদেশের জনগণকে বিভ্রান্ত করে। এই ক্ষেত্রে প্রতিবারই তারা ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধকে সামনে নিয়ে আসে। তারা প্রচার প্রসার করতে চায়, মহান মুক্তিযুদ্ধে তাদের অবদান এত বেশি ছিলো যে, তা না হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হতো না। কিন্তু বাস্তবতা হলো, ভারতের নিজস্বার্থেই বাংলাদেশের স্বাধীনতায় সহযোগিতা করেছে। আর তাদের সহযোগিতা না থাকলেও বীর বাঙালি বাংলাদেশকে স্বাধীন করে ফেলতো। হয়তো কিছুদিন বেশি সময় লাগতো। এছাড়াও বাংলাদেশে আফগানিস্তানপন্থী বা চীনপন্থী রাজনীতির উত্থান ঘটছে বলে তাদের বিভিন্ন প্রচার মাধ্যম অপপ্রচার ও বিকৃত সংবাদ প্রচার করে অহর্নিশ।
ধর্মীয় উস্কানি:
কোনো সাম্প্রদায়িকতা বা ধর্মীয় ইস্যুতে বাংলাদেশে কোনো ঘটনা ঘটলে তা বিকৃত করে উপস্থাপন করে যেন বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন হচ্ছে। এই ধরনের গুজব দুই দেশের মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ও বিদ্বেষ ছড়ায়। ভারত তার গোয়েন্দা সংস্থার 'র'-(RAW) এর মাধ্যমে বাংলাদেশের সংখ্যালঘু নির্যাতনের নাটক তৈরি করে বিশ্ব দরবারে প্রচার করে। ভিডিওতে কী কী বলতে হবে সেই নাটকের স্ক্রিপ্টও তারা লিখে দেয়। অনেক সময় অভিনয় করতে গিয়ে অদক্ষ এই অভিনেতা-অভিনেত্রীগণ ভুল করে ফেলে, সেটিও পরবর্তীতে প্রচার মাধ্যমে ধরা পড়ে। অনেক সময় জায়গা, জমি, সম্পত্তি, ব্যক্তিগত বিরোধ, আর্থিক টানা পোড়েন, পারস্পারিক ঝগড়া-বিবাদ, ইত্যাদির কারণে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিজেদের ভিতরে দাঙ্গা হাঙ্গামা ঘটলেও সংখ্যালঘুদের উপর বাংলাদেশের মুসলমানগণ নির্যাতন চালাচ্ছে বলে অপপ্রচার করে। দুর্ঘটনা কবলিত কোন বাস বা ট্রেনে অগ্নিকাণ্ডের কারণে যদি কোন হিন্দু ধর্মাবলম্বী মৃত্যুবরণ করে অথবা বাড়িতে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট অথবা অন্য যে কোনো কারণে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলে তাতে কেউ পুড়ে মারা গেলেও মুসলমানগণ পুড়িয়ে হত্যা করছে বলে অপপ্রচার অব্যাহত রাখে।
সীমান্ত ইস্যুতে মিথ্যাচার:
বিএসএফের গুলি বা সীমান্তে নিরীহ বাংলাদেশিদের হত্যার প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়ে মিডিয়াগুলো প্রায়শই বাংলাদেশিদের 'অনুপ্রবেশকারী' ও 'সন্ত্রাসী' বা 'চোরাকারবারি' হিসেবে চিত্রিত করে।
ভুয়া ভিডিও ও তথ্যচিত্র:
সামাজিক মাধ্যমে বিশেষ করে ইউটিউব চ্যানেলগুলোয় অনেক সময় পুরণো ভিডিও বা অন্য দেশের ভিডিওকে বাংলাদেশের ঘটনা বলে চালিয়ে দেয়। এমনকি AI বা ভুয়া অডিও- ভিডিও দিয়ে মনগড়া ভাষণও তৈরি করে। এ সমস্ত অডিও-ভিডিও তে বরাবরই সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক বিভিন্ন ধরনের প্রচারণা চালানো হয়, যা স্বাধীন সার্বভৌম দেশ হিসেবে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের চূড়ান্ত নগ্নরূপ।
গুজবের প্রভাব:
ভারতীয় মিডিয়ার এই ধরনের গুজব ও বিশ্বব্যাপী সেই সমস্ত গুজব ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়ার কারণে বাংলাদেশের জন্য নানা ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে।
১। কূটনৈতিক সম্পর্কে নেতিবাচক প্রভাব:
যখন ভারতীয় মিডিয়ায় বাংলাদেশের বিরুদ্ধে নেতিবাচক প্রচার চলে, তখন দুই দেশের মধ্যকার বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বিশেষ করে জনমনে ভারতের প্রতি বিরূপ মনোভাব সৃষ্টি হয়, যা কূটনৈতিকভাবে উদ্বেগজনক। এছাড়াও বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশকে বিরূপভাবে উপস্থাপনের কারণে অনেক ক্ষেত্রেই কূটনৈতিকভাবে বাংলাদেশকে বিভিন্ন প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়। মাঝেমধ্যে বিতর্কিত হতে হয়। এবং অবান্তর ও অবাস্তব প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে কূটনৈতিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় উপস্থাপনের সময় বিনষ্ট হয়।
২। অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিভ্রান্তি
যখন ভারতীয় মিডিয়া কোনো বিশেষ দলকে পাকিস্তানের ‘এজেন্ট’ বা ‘প্রোটেক্টেড’ হিসেবে চিত্রায়িত করে, তখন তা দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিভ্রান্তি ও উত্তেজনা তৈরি করে। অথচ বাস্তবতা হলো পাকিস্তানের সাথে বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দলের দূরতম সম্পর্কও নেই।
৩। সাম্প্রদায়িক উস্কানি:
ধর্মীয় সংখ্যালঘু ইস্যুতে ভারতীয় মিডিয়ার গুজব সরাসরি বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বাড়িয়ে দেয়। এই ধরনের গুজব সামাজিক স্থিতিশীলতা বিনষ্ট করে। ভারতের বর্তমান প্রশাসনও এমনটি চায়। তাদের পাতা ফাঁদে বাংলাদেশের মানুষ পা দিক এবং সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বেঁধে যাক। তখন তারা পৃথিবীব্যাপী বলতে পারবে, বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন হচ্ছে। অথচ ভারত তাদের দেশে মুসলমানদের নির্যাতন করতে করতে পৃথিবীর সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। ভারত প্রতিনিয়ত মসজিদ মাদ্রাসা গুড়িয়ে দিচ্ছে। মুসলিমদের বাস্তুচ্যুত করছে। মুসলিমদের জায়গা জমি সহায় সম্পত্তি দখল করছে। মুসলিম নারীদেরকে ধর্ষণ করছে। এতে বাধা দিতে গেলেই মুসলিম পুরুষদেরকে তারা জনসম্মুখে হত্যা করছে। বিভিন্ন ধরনের পাশবিক নির্যাতন তারা চালিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।
৫। সামাজিক বিভ্রান্তি ও নিরাপত্তাহীনতা:
গুজব ছড়ালে সাধারণ জনগণের মধ্যে আতঙ্ক ছড়ায়। অনেক সময় এসব গুজব ভাইরাল হয়ে সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে। সমাজের মানুষ দ্বিধা বিভক্ত হয়ে পড়ে। মানুষের প্রতি মানুষের আস্থা বিশ্বাস ভালোবাসা সহনশীলতা থাকেনা। বরং মানুষের প্রতি অবিশ্বাস অনস্থা তৈরি হয়। এতে মানসিকভাবে প্রথমে দূরত্ব বিভেদ বৃদ্ধি পায়। এরপর ধীরে ধীরে সেটি সংঘর্ষে রূপ নেয়। বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থাকে অসহনশীল অসংবেদনশীল এবং ফ্যাসিবাদী করার জন্য ভারতীয় মিডিয়া মুখ্য ভূমিকা রাখছে। ভারতের মোদি মিডিয়া ও গদি মিডিয়ার এই ধরনের অপপ্রচার, মিথ্যাচার, গুজব, ভিত্তিহীন সংবাদ বাংলাদেশের সমাজ ব্যবস্থায় বিরূপ প্রভাব ফেলছে। সুতরাং বাংলাদেশের উচিত এ বিষয়ে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
বাংলাদেশের করণীয়:
ভারতীয় মিডিয়ার গুজবের মোকাবেলায় বাংলাদেশকে বহুমাত্রিক উদ্যোগ নিতে হবে। যেমন -
১।তথ্য প্রতিরোধ ব্যবস্থা জোরদার করা:
সরকারি মিডিয়া সেল গঠন: দ্রুত একটি মিডিয়া ইউনিট গঠন করা উচিত যারা ভারতীয় মিডিয়ায় প্রচারিত ভুয়া খবর যাচাই করে তাৎক্ষণিকভাবে বাংলা ও ইংরেজিতে সঠিক সংবাদ পরিবেশন করবে।
ফ্যাক্ট-চেকিং টিম: রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে একটি দক্ষ ফ্যাক্ট-চেকিং প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা জরুরি, যেটি প্রতিদিন ভারতীয় মিডিয়াগুলোর খবর পর্যবেক্ষণ করবে।
২।জনসচেতনতা বৃদ্ধি:
মিডিয়া লিটারেসি শিক্ষা: স্কুল-কলেজ পর্যায়ে গুজব চিনে ফেলার ও তথ্য যাচাইয়ের শিক্ষা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
সোশ্যাল মিডিয়া ক্যাম্পেইন: ফেসবুক, ইউটিউব ও এক্স (সাবেক টুইটার)-এ নিয়মিতভাবে তথ্য যাচাই বিষয়ক সচেতনতামূলক কনটেন্ট প্রচার করতে হবে।
৩। কূটনৈতিক উদ্যোগ:
ভারতের কাছে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ: বাংলাদেশ সরকারকে নিয়মিতভাবে ভারতীয় হাইকমিশনের মাধ্যমে গুজব ও অপপ্রচারের বিষয়ে কূটনৈতিক প্রতিবাদ জানাতে হবে।
আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রচার: ভারতীয় মিডিয়ার গুজবের বিষয়টি আন্তর্জাতিক ফোরাম যেমন জাতিসংঘ, UNESCO, SAARC, BRIMSTEC ইত্যাদিতে তুলে ধরতে হবে।
৪। নিজস্ব মিডিয়া শক্তি গড়ে তোলা:
আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে বাংলাদেশি উপস্থিতি: আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে বাংলাদেশের সাংবাদিক, বিশ্লেষক ও কূটনীতিকদের উপস্থিতি বাড়াতে হবে যাতে ভুয়া প্রচারের বিরুদ্ধে তাৎক্ষণিক জবাব দেয়া যায়।
ইউটিউব ও সোশ্যাল মিডিয়ায় বাংলাদেশি কনটেন্ট: দেশপ্রেমিক ও দক্ষ কনটেন্ট নির্মাতাদের উৎসাহিত করে আন্তর্জাতিক মানের বাংলা ও ইংরেজি ভাষায় তথ্যভিত্তিক কনটেন্ট বানাতে সহায়তা করতে হবে।
৫। আইনি ব্যবস্থা:
সাইবার নিরাপত্তা আইন: বিদেশি গুজব মোকাবেলায় বিদ্যমান ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রয়োগকে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী সংস্কার ও প্রয়োগ করতে হবে।
মিথ্যা প্রচারকারীদের তালিকা তৈরি: ভারতীয় কিছু মিডিয়া চ্যানেল এবং ইউটিউবারদের নির্দিষ্ট তালিকা তৈরি করে তা জনসমক্ষে প্রকাশ ও তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা যেতে পারে।
ভারতীয় মিডিয়ার গুজব শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা উপমহাদেশে অস্থিরতা সৃষ্টি করছে। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য এটি বিশেষভাবে উদ্বেগজনক কারণ এখানে গুজব রাজনৈতিক, ধর্মীয় ও কূটনৈতিক ক্ষেত্রে বহুমাত্রিক প্রভাব ফেলে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় একমাত্র পথ হলো তথ্যভিত্তিক, জনসচেতনতামূলক এবং কূটনৈতিকভাবে শক্ত প্রতিক্রিয়া। একইসাথে, নিজেদের মিডিয়া শক্তিকে আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছে দিতে না পারলে এ ধরনের অপপ্রচার আরও বৃদ্ধি পাবে। অতএব, গুজবকে কেবল অগ্রাহ্য করে নয়, বরং পরিকল্পিতভাবে প্রতিরোধ করে জাতীয় নিরাপত্তা ও ভাবমূর্তি রক্ষা করতে হবে।
লেখক: রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও কলামিস্ট।
আরও পড়ুন: