সোমবার

৯ জুন, ২০২৫
২৫ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২
১৩ , ১৪৪৬

ত্যাগ ও মানবিক মূল্যবোধের এক অনন্য উদাহরণ পবিত্র ঈদুল আজহা

ফাহিম হাসনাত

প্রকাশিত: ৮ জুন, ২০২৫ ২০:০২

আপডেট: ৮ জুন, ২০২৫ ২০:৩২

শেয়ার

ত্যাগ ও মানবিক মূল্যবোধের এক অনন্য উদাহরণ পবিত্র ঈদুল আজহা
ত্যাগ ও মানবিক মূল্যবোধের এক অনন্য উদাহরণ পবিত্র ঈদুল আজহা।

আত্মত্যাগ, ত্যাগ ও মানবিক মূল্যবোধের এক অনন্য উদাহরণ পবিত্র ঈদুল আজহা। মুসলিম জাহানের অন্যতম প্রধান এই ধর্মীয় উৎসব সারা বিশ্বে শান্তি, আনন্দ ও পরিশুদ্ধতার বার্তা নিয়ে আসে। ঈদের আনন্দে প্রতিটি মুসলিম হৃদয় ছুঁয়ে যায় উৎসর্গ ও দানের মহিমায়। চলতি বছরের ঈদুল আজহা উদযাপন নিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ব্যক্ত করেছেন তাদের ভাবনা, অনুভব ও প্রত্যাশা। কারো জন্য এই ঈদ বাড়িতে পরিবার-পরিজনের সঙ্গে কাটানোর প্রতীক্ষা, কারো জন্য আবার এটি আত্মত্যাগের মূল শিক্ষা নিজের জীবনে ধারণ করার এক নতুন উপলক্ষ।

ডিজিটাল যুগে ঈদের নতুন রূপ:

এক সময় ঈদ ঘিরে ছিল চরম উত্তেজনা, নতুন জামা, আত্মীয়দের বাড়ি যাওয়া, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা আর পাড়া-মহল্লায় বাজির আওয়াজ। সেই প্রাণখোলা আনন্দ এখন কিছুটা ফিকে, এমনটাই মনে করেন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষার্থী নুসরাত জাহান অর্পিতা। তার মতে, সকালে নামাজ পড়ে সবাই মোবাইলে ব্যস্ত, কোরবানির পশু কেনা মানেই ছবি তুলে পোস্ট করা, আর বন্ধুদের সঙ্গে দেখা হওয়ার চেয়ে স্টোরিতে মুহূর্ত শেয়ার করাই যেনো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আনন্দ এখন একসঙ্গে ভাগ করে নেয়ার মধ্যে নেই, বরং স্ক্রিনে 'কাকে কেমন দেখাচ্ছে' আর 'কার ছবিতে কত লাইক' পেলো, তা নিয়েই যেনো বেশি ভাবনা। অর্পিতা আহ্বান জানান, স্ক্রিনের বাইরে এসে পরিবারের সঙ্গে সময় কাটাতে, প্রিয়জনের মুখোমুখি হাসতে এবং ছোট ছোট আনন্দ ভাগ করে নিতে, যাতে ঈদের আসল রঙ ফিরে আসে।

ত্যাগের বার্তা: শুধু উৎসবে নয়, জীবনেও

ফিন্যান্স বিভাগের শিক্ষার্থী সামিউ রিকাবদার রাফিউ ঈদুল আজহাকে ত্যাগের মহিমায় পালিত এক পবিত্র দিবস হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, 'এটি কেবল পশু কোরবানির মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এর তাৎপর্য নিহিত রয়েছে আমাদের অন্তরের গভীর ত্যাগ ও আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য আত্মকেন্দ্রিক স্বার্থ বিসর্জনে।' তার মতে, এই আত্মত্যাগের শিক্ষা কেবল ধর্মীয় পরিধিতে সীমাবদ্ধ নয়, বরং সম্প্রতি দেশের গণতান্ত্রিক ও স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনে শহীদদের আত্মত্যাগের মাধ্যমে এর বাস্তব দৃষ্টান্ত দেখা গেছে। রাফিউর প্রার্থনা, আল্লাহ যেনো সবার ইবাদত ও কোরবানি কবুল করে নেন এবং শহীদদের আত্মার মাগফিরাত দান করেন, যাতে একটি গণতান্ত্রিক ও মানবিক বাংলাদেশ গড়া সম্ভব হয়।

আত্মিক প্রশান্তি ও মানবিকতার চেতনা:

অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের শিক্ষার্থী রিয়াতুল ইসলাম রাব্বি ঈদুল আজহাকে আত্মত্যাগ, ভ্রাতৃত্ব ও আত্মিক প্রশান্তির এক অনন্য অনুভব হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি হযরত ইব্রাহিম (আ.)-এর নিঃস্বার্থ ত্যাগের স্মরণে কোরবানির তাৎপর্য তুলে ধরেছেন এবং বলেছেন যে, 'আল্লাহর কাছে তাদের গোশত ও রক্ত পৌছে না, বরং তোমাদের তাকওয়া পৌছে।' (সূরা হজ্ব ২২:৩৭)। শহুরে জীবনের ব্যস্ততার মাঝে ঈদ তাদের নিজের ভেতরে ও আপনজনের কাছে ফিরিয়ে আনে, যা আত্মিক পুনর্জাগরণ ঘটায়। রাব্বি প্রত্যাশা করেন, প্রথার বাইরে গিয়ে সবাই যেনো তাকওয়া অর্জনে সচেষ্ট হয়।

অন্যদিকে, লোক প্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী হাবিবুল বাশার সুমন ঈদুল আজহাকে মুসলিম উম্মাহর জন্য এক শাশ্বত আদর্শের প্রতীক বলেছেন, যেখানে আত্মত্যাগ ও আনুগত্যের অপূর্ব সমন্বয় ঘটে। তার মতে, প্রাণী কোরবানির অন্তরালে লুকিয়ে আছে নিজস্ব অহংকার, লোভ, স্বার্থপরতা ও আত্মকেন্দ্রিকতা ত্যাগ করার শিক্ষা। ঈদের প্রকৃত রূপ তখনই উদ্ভাসিত হয়, যখন এই আত্মত্যাগ আমাদের মন-মানসিকতা, আচরণ ও পারস্পরিক সম্পর্কের প্রতিফলনে দৃশ্যমান হয়। এই দিনে ধনী-গরিবের ভেদাভেদ ভুলে সবাই এক কাতারে ঈদের নামাজে অংশগ্রহণ করে, যা সম্প্রীতির এক অনন্য দৃশ্য।

আরেকজন লোক প্রশাসন বিভাগের শিক্ষার্থী তাহাসিনুল ইসলাম ঈদুল আজহাকে 'অন্তর্জগতের এক আলোড়ন' হিসেবে বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, 'এই দিনটি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় এক অতল সত্য, আল্লাহর পথে আত্মসমর্পণই মানব জীবনের পরম সার্থকতা। তার মতে, কোরবানি শুধু ছুরি চালানো নয়, এটি নিজেকে প্রশ্ন করার একটি ক্ষণ কী ত্যাগ করেছি আমরা? কী পেরেছি আমরা হৃদয়ের পশুটিকে নিধন করতে? তিনি জোর দিয়েছেন যে, অহংকারের পশু, লোভের পশু, ক্রোধের পশু, এসব যদি জবাই না করা যায়, তবে রক্তপাত অর্থহীন।'

সর্বোপরি, অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের শিক্ষার্থী তাফহিম রাফি ঈদুল আজহাকে ত্যাগ, তাকওয়া ও ভ্রাতৃত্ববোধের শিক্ষা হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তিনি ইব্রাহিম (আ.)-এর ত্যাগের দৃষ্টান্ত তুলে ধরে বলেন, ঈদ কেবল পশু জবাই নয়; এটি আল্লাহভীতি, তাকওয়া, সহমর্মিতা ও সামাজিক সাম্যের বহিঃপ্রকাশ। সামর্থ্যবান মুসলমানেরা পশু কোরবানি করে তা তিন ভাগে ভাগ করে, যা সমাজে ভ্রাতৃত্ব, ভালোবাসা ও সম্মান বজায় রাখে। ঈদগাহে একত্রিত হয়ে মুসলিমরা সকল ভেদাভেদ ভুলে কোলাকুলি করে, যা ইসলামের ভ্রাতৃত্ববোধের জীবন্ত নিদর্শন।

সবমিলিয়ে, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের ভাবনা থেকে স্পষ্ট হয় যে, আধুনিকতার ছোঁয়ায় ঈদের আনন্দ কিছুটা বদলে গেলেও, ত্যাগের মহিমা, মানবিকতার শিক্ষা আর পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনের গুরুত্ব আজও সমানভাবে বিদ্যমান। এই ঈদ হোক মুখোমুখি সম্পর্ক আর মন ছুঁয়ে যাওয়ার এক আন্তরিক উৎসব। সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা, ঈদ মোবারক।

banner close
banner close