রবিবার

২৮ ডিসেম্বর, ২০২৫ ১৩ পৌষ, ১৪৩২

ইতিহাসের পাতায় পাক-ভারত যুদ্ধ ও ভারতীয় মিডিয়ার ঐতিহাসিক মিথ্যাচার

অনিরুদ্ধ অনিকেত

প্রকাশিত: ১৬ মে, ২০২৫ ২০:৪৩

আপডেট: ১৬ মে, ২০২৫ ২০:৪৫

শেয়ার

ইতিহাসের পাতায় পাক-ভারত যুদ্ধ ও ভারতীয় মিডিয়ার ঐতিহাসিক মিথ্যাচার
ছবি:বাংলা এডিশন

দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে দুটি দেশের জন্মলগ্ন থেকেই ভারত -পাকিস্তানের মাঝে বৈরিতার সৃষ্টি। ১৯৪৭ থেকে ২০২৫ সাল। মাঝখানে চলে গেছে ৭৮টি বছর। অর্থাৎ পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে দ্বন্দ্বের ইতিহাস সেই হিসেবে প্রায় সাত দশক। ১৯৪৭ সালের দেশ বিভাজনের সময় ব্রিটিশ কর্তৃক ইচ্ছাকৃতভাবে অনিষ্পন্ন কাশ্মীর ইস্যুকে কেন্দ্র করে এই দুই প্রতিবেশী দেশের মধ্যে বহু ছোট বড় যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছে। কিন্তু এই যুদ্ধগুলোর ক্ষয়-ক্ষতি জয়-পরাজয়ের প্রকৃত চিত্র মানুষের কাছে পৌঁছায় না। কারণ নিয়ন্ত্রিত মিডিয়া ও বিশ্বশাসনের এজেন্ডাধর্মী সংবাদ পরিবেশনের কারণে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সত্য ‍ও সঠিক চিত্র সাধারণ মানুষের অগোচরেই রয়ে যায়। চিরকালই গণমাধ্যম একটি শক্তিশালী হাতিয়ার যা যুদ্ধকালীন সময়ে জনমত গঠন করে এবং যুদ্ধের ন্যারেটিভ নিয়ন্ত্রণ করে। বলা যায়, the pen is mighter than the sword. এই সুযোটিই বিশ্বের বিভিন্ন মিডিয়া অপপ্রয়োগ করে। অর্থাৎ নৈতিকতা মিডিয়া নিয়ন্ত্রকের মুখে থাকলেও তা কলমের মুখে আসে না। এ ক্ষেত্রে বরাবরই ভারতীয় মিডিয়া বিশ্বের অপ্রতিদ্বন্দ্বি ১ নম্বর। ভারতীয় মিডিয়া, বিশেষ করে টেলিভিশন ও অনলাইন পোর্টালগুলো, এসব যুদ্ধে বারবার বিভ্রান্তিকর, অসত্য, অতিরঞ্জিত, সাম্প্রদায়িক উস্কানিমূলক, মানবতাবিরোধী, প্রতিবেশি রাষ্ট্রের জন্য হানিকর, নিজেদের কল্পিত ক্ষমতার বাগাড়ম্বরপূর্ণ এবং রাজনৈতিকভাবে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত সংবাদ প্রচার করে আসছে। পক্ষপাতদুষ্ট ও হলুদ সাংবাদিকতার রোল মোডেল এই সমস্ত হাস্যকর মিডিয়া শুধুই ভারতকে অপার শক্তিশালী, ন্যায়বান, অপরাজেয় এবং যুদ্ধশেষে বিজয়ী হিসেবে তুলে ধরে। পক্ষান্তরে, পাকিস্তানকে ‘সন্ত্রাসের অভয়রাণ্য, সন্ত্রাসবাদী, জঙ্গি, সন্ত্রাসে মদদদাতা, ভীরু, কাপুরুষ, দুর্বল ও চিরপরাজিত হিসেবে চিত্রিত করে।

পাক-ভারত যুদ্ধ: ইতিহাসের পাতায়

বিরোধ, সংগ্রাম, সংঘর্ষ, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও অবিরাম মতবিরোধের মধ্য দিয়েই ১৯৪৭ সালে ভারত-পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম। ১৯৪৭-৪৮, ১৯৬৫, ১৯৭১, ১৯৯৯, ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ কারগিল যুদ্ধসহ সাম্প্রতিক সীমান্ত উত্তেজনা, ‘অপরাশেন সিঁদুর’, ‘অপারেশসন বুনিয়া উম মারসুস’ তথা ২০২৫ সালের প্রযুক্তি নির্ভর যুদ্ধের মতো ঘটনার প্রেক্ষিতে ভারতীয় মিডিয়ার স্বভাবসুলভ নজিরবিহীন মিথ্যাচার, তথ্যবিকৃতি, সত্যের অপলাপ ও সাম্প্রদায়িক প্রোপাগান্ডার দিকগুলোর পাশাপাশি এর আঞ্চলিক প্রভাব, আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া এবং বাংলাদেশি মিডিয়ার সত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টাও সমধিক গুরুত্বপূর্ণ। তাই এসব বিষয়ে একটি সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ করা যেতেই পারে।

১৯৪৭-৪৮ কাশ্মীর যুদ্ধ
ব্রিটিশ ভারতের ১৯৪৭ সালের বিভাজনের সময়, জম্মু ও কাশ্মীর ছিলো একটি স্বাধীন রাজ্য। যার শাসক ছিলেন হিন্দু মহারাজা হরি সিং। যদিও রাজ্যের জনসংখ্যার বেশিরভাগই ছিলেন মুসলিম। কিন্তু পাকিস্তান আলাদা হওয়ার সাথে সাথেই ভারতীয় উস্কানিতে সংখ্যা গরিষ্ট মুসলমান বিরোধী কাজ শুরু করেন অত্যাচারী মহারাজা, হরি সিং। ফলে নিপীড়িত মুসলিমদের পাশে দাঁড়াতে ২২ অক্টোবর ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান-সমর্থিত পশতুন উপজাতীয়দের একটি মুসলিম উদ্ধারকারী দল কাশ্মীরে প্রবেশ করে। ফলে মওকা বুঝে গোপন পরিকল্পনা মোতাবেক সাম্প্রদায়িক মহারাজা, হরি সিং ভারতের সাথে অন্তর্ভুক্তির জন্য Instrument of Accession চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এবং ভারতীয় সেনাবাহিনী কাশ্মীরে প্রবেশ করে। এখানে পাকিস্তানের বড় ব্যর্থতা ছিলো, তারা কাশ্মিরকে স্বাধীন রাখতে পারে নি। তবে পাক-ভারতের সংসার আলাদা হলে ভারত পাকিস্তানকে কোন আর্থিক বেনিফিট দেয় নি। সমস্ত অর্থ ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকেই রয়ে যায়। এই অর্থের ভাগ মহাত্মা গান্ধি দিতে গিয়েও ব্যর্থ হন। তার উপদেশ উগ্র সাম্প্রদায়িক ভারতের নেতৃবৃন্দ পাত্তা দেননি। ফলে অর্থনীতি ও সমরাস্ত্র শূন্য একটি নতুন রাষ্ট্র কোন ভাবেই ভারতের সুসংগঠিত সেনাবাহিনীর মোকাবেলায় সক্ষম ছিলো না। এভাবেই ভারত একটি স্বাধীন রাষ্ট্রকে গিলে খায়, যেমন পরবর্তীতে সিকিম ও হায়দারাবাদকেও তারা গিলে খায়। অথচ আধিপত্যবাদী ও অন্যের দেশ দখলকারী ভারত হলেও এই যুদ্ধে ভারতীয় মিডিয়া কাশ্মীরের মুসলমানদের বিদ্রোহকে পাকিস্তানের ষড়যন্ত্র হিসেবে চিত্রিত করে।

১৯৬৫ সালের যুদ্ধ
এই যুদ্ধও কাশ্মীর কেন্দ্রিক। এটিকে পাক-ভারতের দ্বিতীয় যুদ্ধ বলে। তারিখ ৫, আগস্ট-২৩, সেপ্টেম্বর ১৯৬৫। ফলাফল: চূড়ান্ত জয়-পরাজয় অমীমাংসিত। জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতি হয়। দুই দেশেরই সীমান্ত অপরিবর্তিত থাকে। এই যুদ্ধে পূর্বপাকিস্তান বর্তমানে বাংলাদেশের বীর জনতা অমিত তেজে ভারতকে দখল করে। মূলত এই উভয় পাকিস্তানের অসমসাহসিক অভিযানে ভীত সন্ত্রস্থ হয়ে ভারত জাতিসংঘের দ্বারস্থ হয়। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম দুইদেশকেই সমভাবে দোষারোপ করলেও ভারতীয় মিডিয়া দাবি করে যে, পাকিস্তান আগে যুদ্ধ শুরু করেছে। এবং ভারতীয় মিডিয়া জনমত গঠনে ভারতের কথিত আত্মরক্ষার যুক্তি শক্তিশালীভাবে তুলে ধরে।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধ

এই যুদ্ধ মূলত বাংলাদেশ স্বাধীনতার প্রসঙ্গে হলেও ভারত-পাকিস্তান সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। কারণ ইতোপূর্বে ভারত কখনো পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধে জয়ী হতে পারে নি। এর বৃহৎ কারণ তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানের বীর জনতা ও যুবক-তরুণ সিপাহ সালার। ফলে ভারত বাংলাদেশকে আলাদা করে দেওয়ার চূড়ান্ত ষঢ়যন্ত্র করে। এছাড়া পাকিস্তানের সাথে তাদের টিকে থাকা সম্ভব নয়। এই হিসেবে তারা শেখ মুজিবুর রহমানকে গড়ে তুলতে শুরু করে। ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এখানে ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। ২৪ বছর পাকিস্তানের বিভিন্ন বৈষম্য ও নিপীড়নের শিকার বংলার জনতা ১৯৭১ সালে জেগে ওঠে। এবং স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমি রচয়িতা শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণে উদ্দীপ্ত হয়। এবং ২৬ মার্চ বাংলাদেশের সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সৎ ও যোগ্য রাষ্ট্র নায়ক জেনারেল জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ এক ন্যায় সংগত যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পাকিস্তান শোচনীয় পরাজয় বরণ করে। সেই মুহূর্তে ভারত বাংলাদেশের সকল সম্পদ লুণ্ঠন ও বুদ্ধিজীবী হত্যায় মেতে ওঠে। এই পরিস্থিতে ‘র’ এর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে পাকবাহিনী ভারতের কাছে আত্মসমার্পণ করতে বাধ্য হয়। এটির সাথে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রত্যক্ষ ও সক্রিয় সংযোগ ছিলো। অর্থাৎ বাংলার বিজয়কে ভারতের হাতে তুলে দিলেন। এই একটি বারই ভারত জিতে ছিল। জয় বললে ভুল হবে। ক্রিকেট খেলার মতো আমাদের বিজয়কে তারা চুরি করে নেয়। এখন যেমন আইসিসি তাদের দেয়। তেমনি ’৭১-এ শেখ মুজিব তাদের এই জয় উপহার দেয়। অথচ, ভারতীয় মিডিয়া এ সময় আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের জন্য মানবিক সংকটকে ব্যবহার করে এবং নিজেদের ভূরাজনৈতিক স্বার্থের দিকটা আড়াল করে রাখে। বিশ্বব্যাপী তাদের বিজয় হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার মিথ্যা প্রচার চালাতে থাকে।

১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধ

কারগিল যুদ্ধেও পাকিস্তানের নিকট ভারত শোচনীয় পরাজয় বরণ করে। লেখার কলেবর বৃদ্ধিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সবিস্তারে লিখছি না। পরে অন্য কোন আর্টিকেলে তুলে ধরা হবে। ভারত হারলেও কারগিল যুদ্ধের সময় ভারতীয় মিডিয়া জোরালোভাবে প্রচার চালায় যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী লাইন অব কন্ট্রোল (LoC) অতিক্রম করে ভারতের ভূমিতে ঢুকে পড়েছে। যদিও সত্য ছিল-এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ ও দখল নিয়ে মতপার্থক্য বহুদিন ধরেই চলমান। মিডিয়া একতরফাভাবে পাকিস্তানকে আগ্রাসী হিসেবে তুলে ধরে। গতানুগতিক ধারার ফাতরা মিডিয়ার বয়ান তারা অব্যাহত রাখে।

সার্জিক্যাল স্ট্রাইক (২০১৬, ২০১৯)
২০১৬ সালে উরিতে ভারতীয় সেনাঘাঁটিতে হামলার প্রতিক্রিয়ায় ভারতের সেনাবাহিনী ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’ চালায় বলে দাবি করে ভারত ও ভারতীয় মিডিয়া। ভারতীয় মিডিয়া হাউকাউ করে প্রচার করে যে পাকিস্তানের ভেতরে ঢুকে ‘জঙ্গি ঘাঁটি ধ্বংস করা হয়েছে’। যদিও পাকিস্তান এই দাবি দৃঢ়তার সাথে অস্বীকার করে এবং পরবর্তীতে নিরপেক্ষ তদন্তে এ বিষয়ে স্পষ্ট কোন প্রমাণ মেলেনি। বরাবরের মতো পাকিস্তানকে পরাজিত করার এক পরিকল্পিত কল্পকাহিনী নির্ভর এক চলচ্চিত্র বানায় তারা, যেখানে পাকিস্তান বাহিনীকে পুরোপুরি পর্যুদস্ত করে বলে সাড়ম্বরে প্রদর্শন করে। ‘পাগলের সুখ মনে মনে’ টাইপের আর কি!

মে, ২০২৫ এর অপারেশন সিদুঁর ও অপারেশসন বুনইয়া উম মারসুস [بُنۡیَانٌ مَّرۡصُوۡصٌ]
পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সাম্প্রতিক সংঘর্ষ ২০২৫ সালের মে মাসে সংঘটিত হয়; যা ১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধের পর সবচেয়ে গুরুতর সামরিক সংঘর্ষ ও সর্বাত্মক যুদ্ধ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। এই যুদ্ধের সূচনা হয় ২২ এপ্রিল, ২০২৫ তারিখে জম্মু ও কাশ্মীরের পাহালগামে একটি সন্ত্রাসী হামলার মাধ্যমে, যেখানে ২৬ জন পর্যটক নিহত হন। ভারত এই হামলার জন্য ভারতীয় বয়ান নির্ভর পাকিস্তান-ভিত্তিক তথাকথিত জঙ্গি গোষ্ঠী ‘লস্কর-ই-তৈয়াবা ও জইশ-ই-মোহাম্মদকে’ দায়ী করে। এর মধ্য দিয়ে দুই দেশের মধ্যে শুরু হয় বাগযুদ্ধ। কোন স্পষ্ট প্রমাণ ছাড়াই চরম আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে পাকিস্তানকে আক্রমণের স্বপ্ন দেখে ভারত।

অপারেশন সিদুঁর
৭ মে, ২০২৫ তারিখে ভারত ‘অপারেশন সিদুঁর’ নামে একটি সামরিক অভিযান চালায় পাকিস্তানে। বেসামরিক নাগরিককে টার্গেট করে ভারত। যুদ্ধে জয়লাভের থেকে তাদের লক্ষ্য ছিলো সুন্দর একটি সিনেমা বানানো; যে কারণে একটি রোমান্টিক নাম সিলেক্ট করে। অপারেশনের নাম দেয়-‘অপারেশন সিদুঁর’। এই অভিযানে ভারতীয় বিমানবাহিনী রাফাল জেট ব্যবহার করে পাকিস্তানের বাহাওয়ালপুর, মুরিদকে, সিয়ালকোট, কোটলি ও মুজাফফরাবাদসহ ০৯টি স্থানে হামলা চালায় ভারত। পাকিস্তান দাবি করে যে, এই হামলায় ৩১ জন বেসামরিক নাগরিক শহীদ হন, যার মধ্যে মসজিদে নামাজরত ব্যক্তিরাও ছিলেন ।

অপারেশসন বুনইয়া উম মারসুস এর শক্ত জবাব ও যুদ্ধবিরতি
ভারতের এমন কাপুরুষোচিত হামলার জবাবে পাকিস্তান অপারেশসন্স বুনইয়া উম মারসুস পরিচালনা করে। সেই শাশ্বত অভিযানে পাকিস্তান ভারতীয় হামলার পাল্টা প্রতিক্রিয়ায় ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। দুই দেশের মধ্যে সীমান্তে গোলাগুলি ও সংঘর্ষ চলতে থাকে। এই যুদ্ধে ভারত ফ্রান্সের তৈরি অথ্যাধুনিক যুদ্ধ বিমান রাফায়েল হারায়। পাকিস্তান এয়ার ফোর্সের আয়েশা একাই ৫ বিমানকে ভূপাতিত করে নজিরবিহীন যুদ্ধক্যারিশমা প্রদর্শন করে। এই যুদ্ধে পাকিস্তান বিমান বাহিনী ভারতের আকাশ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে। ৩টি রাফায়েল, ১টি করে সু-৩০, মিগ-২৯ ভারতীয় যুদ্ধবিমান ভূপাতিত, শতাধিক ড্রোন ও শতাধিক লোটারিং অস্ত্র ভূপাতিত করে। নিয়ন্ত্রণ রেখা সংলগ্ন বহুসংখ্যক ভারতীয় সামরিক চেকপোস্ট ধ্বংস। ৮০-৯০ জন ভারতীয় জওয়ান নিহত। ৪টি ভারতীয় ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারে হামলায় বিপর্যুদস্ত হয়। পাকিস্তানের চরম বিধ্বংসী যুদ্ধের ডামাডোলে মুম্বাই সিনেমার নায়ক মোদি চরম আতংকিত হয়ে মার্কিন প্রেসিডেন্টকে করজোড়ে অনুরোধ করে-পাকিস্তানকে থামানোর জন্য। ১০ মে, ২০২৫ তারিখে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায় একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

এই শোচনীয় পরাজয়ের কারণে মোদি সাহেব ভারতে চরম সমালোচনার মধ্যে পড়ে এবং নিজেকে সামলে নিতে একটি বক্তব্যের আয়োজন করে। সেই বক্তব্যে স্বভাবসুলভ মিথ্যাচার করে বলেন যে, ভারতের ভয়ে পাকিস্তান ট্রাম্পের শরণাপন্ন হয়ে যুদ্ধ বিরতির প্র্রস্তাব দেয়। এমন মিথ্যাচারের প্রেক্ষিতে পাকিস্তান যুদ্ধ বিরতি লংঘন করে ভারতে ড্রোন হামলা চালিয়ে সমুচিত জবাব দিলেও ভারত সাহস করে পাল্টা ব্যবস্থা নেয় নি। এর থেকে প্রমাণিত হয় ভারতই মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের পায়ে পড়েছে।

কূটনৈতিক প্রতিক্রিয়া
এই যুদ্ধে পাকিস্তানের পাশে চীন, তুরস্ক, ইরান, আজারবাইজানের মতো দেশ দাঁড়ালেও ভারতের পাশে কেউ ছিলো না। ভারত দক্ষিণ এশিয়ায় প্রতিবেশিদের উপর আগ্রাসন চালাতে চালাতে এখন বন্ধুশূন্য রাষ্ট্র। এটি ভারতের কূটনৈতিক ব্যর্থতা ও অব্যাহত মিথ্যাচারের চূড়ান্ত কুফল।

যুদ্ধের প্রভাব ও মারাত্মক ক্ষতিকর দিক
২০২৫ এর মে তে সংগঠিত পাক-ভারত যুদ্ধে ভারত কর্তৃক সিন্ধু পানি চুক্তি বাতিল করা হয়। ভারতে পাকিস্তানিদের জন্য ভিসা বাতিল ও ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। ভারত-পাকিস্তান কূটনীতিকদের পাল্টাপাল্টি বহিষ্কার। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও কূটনৈতিক উত্তেজনা মারাত্মক পর্যায়ে চলমান। গেত ১৩ মে, ২০২৫ তারিখে নয়াদিল্লীতে অবস্থানরত পাকিস্তানের কূটনীতিককে ভারত ২৪ ঘন্টার মধ্যে ভারত ছাড়তে নির্দেশ দেয়। যার প্রেক্ষিতে ১৪ মে, ২০২৫ তারিখ পাকিস্তানে নিযুক্ত ভারতীয় এক কূটনীতিককে ‘পারসোনা নন গ্রাটা’ ঘোষণা করেছে ইসলামাবাদ। ডিপ্লোম্যাটিক রীতিনীতিতে ‘পার্সোনা নন গ্রাটা’র অর্থ হচ্ছে ‘অবাঞ্ছিত ব্যক্তি’। ওই কূটনীতিককে পাকিস্তান-ও ভারতের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তান ত্যাগের নির্দেশ দেয়। এছাড়াও পাকিস্তান কর্তৃক ভারতের সাথে তৃতীয় দেশসহ সকল বাণিজ্য স্থগিত হয়। ভারতীয় সকল বিমানের জন্য পাকিস্তানের আকাশ সীমায় নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে পাকিস্তান- এতে ভারতের বিমান যাত্রার ব্যয় কয়েকগুণে বৃদ্ধি পায়। সাথে অমূল্য সময়ের মূল্য তো আছেই। পাকিস্তান কর্তৃক সিমলা চুক্তি বাতিল করা হয়। নিয়ন্ত্রণ রেখা (LoC) বরাবর সশস্ত্র সংঘর্ষ চলমান।

ভারতীয় মিডিয়ার মিথ্যাচারের ধরন ও কৌশল
২০২৫ সালের মে মাসে, ভারতীয় কিছু টেলিভিশন চ্যানেল দাবি করে যে, পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদ দখল করা হয়েছে এবং পাকিস্তানের সেনাপ্রধান আসিম মুনির গ্রেপ্তার হয়েছেন। এই ধরনের ভুয়া খবর সামাজিক মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে, যা পরে মিথ্যা প্রমাণিত হয়। এছাড়াও, পাকিস্তান যুদ্ধবিমান ধ্বংসের ভুয়া ভিডিও, একটি ভিডিও গেমের দৃশ্যকে ভারত কর্তৃক পাকিস্তান যুদ্ধবিমান ধ্বংসের বাস্তব ফুটেজ হিসেবে প্রচার করা হয়। এই ভিডিওটি সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়, কিন্তু পরে এটি ভুয়া প্রমাণিত হয়। ভারতীয় কিছু মিডিয়া চ্যানেল ও সামাজিক মাধ্যম প্ল্যাটফর্মে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিভ্রান্তিকর তথ্য ও ভুয় খবর ছড়ানো হয়। এই ধরনের তথ্য প্রচার যুদ্ধকালীন সময়ে জনমনে আতঙ্ক ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। যখনই কোনো ভারত-পাকিস্তান সংঘর্ষ ঘটে, ভারতীয় মিডিয়া তাদের ‘দেশপ্রেমিক’ ভাবমূর্তিকে ব্যবহার করে একতরফাভাবে পাকিস্তানকে আক্রমণ করে। তারা প্রশ্নবিদ্ধ তথ্য প্রচার করে, সমালোচকদের ‘দেশদ্রোহী’ বলে অভিযুক্ত করে এবং জনসাধারণের যুক্তিবাদী নয়, বরং যুদ্ধবাদী মনোভাব উসকে দেয়।

যুদ্ধকালীন সময়ে ভারতীয় মিডিয়া বারবার এমন তথ্য দেয়, যা পরে মিথ্যা প্রমাণিত হয়। যেমন, পাকিস্তান সেনার শত শত সদস্য নিহত, শত্রুপক্ষের ঘাঁটি ধ্বংস, আত্মসমর্পণের দৃশ্য—যা বাস্তবে ঘটেনি। যেমন ২০১৯ সালের বালাকোট এয়ারস্ট্রাইকে মিডিয়া দাবি করে শতাধিক কথিত জঙ্গি নিহত হয়েছে, কিন্তু পরবর্তীতে স্যাটেলাইট চিত্র এবং আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে তার প্রমাণ পাওয়া যায়নি। অনেক সময় তারা ভিডিও গেম ফুটেজ কিংবা পুরাতন যুদ্ধ দৃশ্য ব্যবহার করে টিভি পর্দায় ‘সেনা অভিযানের’ রোমাঞ্চকর দৃশ্য হাজির করে, যেন পুরো যুদ্ধ বাস্তবে ঘটেছে। এভাবে ভারতীয় মিডিয়া অনেক সময় ভিত্তিহীন ও যাচাই না করা খবর প্রচার করে, বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়া থেকে সংগৃহীত তথ্য নিয়ে। এতে জনগণের মধ্যে যুদ্ধ নিয়ে উত্তেজনা বাড়ে, কিন্তু পরে তা মিথ্যা বলে প্রমাণিত হয়। যেসব সাংবাদিক বা গবেষক যুদ্ধ নিয়ে নিরপেক্ষ বিশ্লেষণ দেন, তাদের ভারতবিরোধী, দেশদ্রোহী তকমা দিয়ে অপমান করা হয়। এভাবে ভিন্নমতকে দমন করে শুধুমাত্র যুদ্ধবাদী কণ্ঠকে প্রচার দেওয়া হয়। ভারতীয় মিডিয়ার যুদ্ধোন্মাদ সংবাদ পাকিস্তানে পাল্টা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। পাকিস্তানের মিডিয়াও একতরফাভাবে ভারতের বিরোধিতা করে। দুই দেশের জনগণ নিজেদের ‘শত্রু’ মনে করতে শুরু করে, যা শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পথে মারাত্মক বাধা। ভারতীয় মিডিয়ার প্রোপাগান্ডা দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে বিপন্ন করে তোলে। বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কার মতো প্রতিবেশীরা এক ধরণের চাপে পড়ে যায় এবং অনেক সময় নিজেদের অবস্থান নিয়ে দ্বিধায় ভোগে। ভারতকে নিয়ে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমের বিব্রতকর প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। বিবিসি, আল-জাজিরা, রয়টার্সসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ভারতীয় মিডিয়ার এই পক্ষপাতদুষ্ট ও তথ্যবিকৃতির প্রবণতা নিয়ে প্রশ্ন তোলে। ভারতের মিডিয়াকে অপেশাদার, উত্তেজনাপ্রবণ এবং সেন্সেশনাল বলেও সমালোচনা করে।

অথচ ব্রিটেনের প্রভাবশালী দৈনিক দ্য গার্ডিয়ান এ Helen Davidson এবং Amy Hawkins এই যুদ্ধ নিয়ে একটি বিশ্লষণধর্মী আর্টিকেল লেখেন। সেখানে তার হেডিং দেয়- Pakistan’s use of J-10C jets and missiles exposes potency of Chinese weaponry. Shooting down of India’s planes by Beijing’s customer Pakistan would mark the first time the fighters and their PL-15 missiles have been used in combat. এই লেখাতে ভারতরে শোচনীয় পরাজয়ের বক্তব্যই তুলে ধরে তারা। একইভাবে বিবিসি, রয়টার্স, সিএনএন, এপি, সিনহুয়া, রেডিও তেহরান, ফ্রান্সের গণমাধ্যম, নিউইয়র্ক টাইমস সবাই মে, ২৫ এর যুদ্ধে ভারতের প্রাথমিক হিসেবে প্রায় ২৩৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ক্ষতি হয়েছে বলে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশ।

ভারতীয় মিডিয়ার মিথ্যাচারের কারণ বিশ্লেষণ
কমশক্তির মানুষ কথায় কথায় বলে, ‘আমি কে জানিস? দেখিয়ে দেবো তাকে।’ ভারতীয় মিডিয়ার মিথ্যাচারের কারণ বিশ্লেষণে এটাই প্রমাণিত হয় যে, পাকিস্তানের চেয়ে ভারতের যুদ্ধকৌশল পিছিয়ে, সুতরাং মিথ্যাচারই একমাত্র সম্বল। ভারতের অনেক মিডিয়া হাউজ সরাসরি শাসকদলের সঙ্গে সম্পৃক্ত অথবা তাদের দ্বারা প্রভাবিত। যুদ্ধ বা সামরিক পদক্ষেপের সমর্থনে জনমত তৈরি করতে তারা সরকারপন্থী প্রোপাগান্ডা চালায়। war বা যুদ্ধ সংক্রান্ত কনটেন্ট বেশি দর্শক টানে। টিভি চ্যানেলগুলোর মধ্যে TRP (Television Rating Point) পাওয়ার প্রতিযোগিতায় তারা যুদ্ধকে নাটকীয়ভাবে উপস্থাপন করে। যখন ভারতের ভেতরে বেকারত্ব, অর্থনৈতিক মন্দা বা সামাজিক অসন্তোষ দেখা দেয়, তখন মিডিয়া যুদ্ধ বা পাকিস্তানবিরোধী বিষয় সামনে এনে জনগণের দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেয়। ভারত নিজেকে দক্ষিণ এশিয়ার একমাত্র প্রভাবশালী রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চায়। মিডিয়া তার এই উচ্চাশাকে জোরদার করতে যুদ্ধের প্রচারণা ও শত্রুতা ছড়াতে সাহায্য করে।

পাক-ভারত যুদ্ধ শুধু দুটি দেশের সেনাবাহিনীর সংঘর্ষ নয়, বরং এটি দুই দেশের জনগণের মানসিকতাকে প্রভাবিত করে এমন এক যুদ্ধ যার জ্বালানি জোগায় মূলধারার মিডিয়া। ভারতীয় মিডিয়া একাধারে জনমত গঠন, তথ্য বিকৃতি এবং রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে ব্যবহৃত হয়েছে। তারা তথ্যের ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে, সাংবাদিকতার মূলনীতি বিসর্জন দিয়ে রাষ্ট্রীয় ও ব্যবসায়িক স্বার্থে প্রোপাগান্ডার মাধ্যমে যুদ্ধের প্রচারণা চালিয়েছে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য প্রয়োজন-তথ্যের সত্যতা যাচাই, প্রত্যেক দেশে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ মিডিয়া কাঠামো গঠন, আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধির মাধ্যমে কূটনৈতিক সমাধান খোঁজা, যুদ্ধ নয়, শান্তির পক্ষে জনমত গঠন। শুধুমাত্র সত্য ও ন্যায়ভিত্তিক সাংবাদিকতা, এবং ইতিহাসের শিক্ষা নিয়ে আগামী প্রজন্মকে যুদ্ধ নয়, বন্ধুত্বের পথে পরিচালিত করা যেতে পারে।

লেখক: কলামিস্ট ও রাজনীতি বিশ্লেষক।



banner close
banner close