শনিবার

১০ মে, ২০২৫
২৭ বৈশাখ, ১৪৩২
১৩ জিলক্বদ, ১৪৪৬

RAW-এর বুদ্ধিতে হাসিনা ও মোদির একই পরিণতি হওয়ার আশঙ্কা

অনিরুদ্ধ অনিকেত 

প্রকাশিত: ১০ মে, ২০২৫ ১৪:২৪

শেয়ার

RAW-এর বুদ্ধিতে হাসিনা ও মোদির একই পরিণতি হওয়ার আশঙ্কা
ছবি: সংগৃহীত

দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর প্রভাব কোনো নতুন ঘটনা নয়। ভারতীয় উপমহাদেশে বিশেষ করে ভারতের বহিঃগোয়েন্দা সংস্থা RAW (Research and Analysis Wing) প্রতিবেশী দেশগুলোর রাজনৈতিক গতিপথ নিয়ন্ত্রণে একটি নীরব অথচ শক্তিশালী শক্তি হিসেবে দীর্ঘদিন কাজ করে আসছে। বাংলাদেশের পলাতক নেত্রী শেখ হাসিনা বিনাভোটে রাষ্ট্র দখলে নিয়েছিলেন। এবং একইভাবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিও রাষ্ট্র ক্ষমতার চূড়ায় অবস্থান করছেন বহু বছর ধরে। কিন্তু তাঁদের শাসনব্যবস্থা, রাজনৈতিক কৌশল ও জনগণের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি যেমন অভিন্ন, তেমনি তাঁদের উত্থান ও টিকে থাকার পেছনেও এক বিশেষ ‘গোপন’ শক্তির ছায়া দেখা যায়- তা হলো RAW-

 RAW-এর সহযোগিতায়  কুশাসক মোদির পাশবিক নেতৃত্বে যে অপশাসনব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, তা যদি এখন‌ই নিয়ন্ত্রণ না করা যায়, তাহলে শেখ হাসিনা ও মোদির পরিণতি অভিন্ন হতে পারে, যদি না মোদি সময় থাকতে গণইচ্ছার কাছে নতিস্বীকার করেন।

RAW: ভারতের ছায়াসেনা RAW-এর জন্ম ১৯৬৮ সালে, শ্রী রামনাথ কাও-এর নেতৃত্বে। পাকিস্তান, চীন ও অন্য প্রতিবেশী রাষ্ট্রের কার্যক্রম নজরে রাখা এবং প্রয়োজনে প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নেয়াই ছিলো এর মূল উদ্দেশ্য। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই RAW কেবল নজরদারি নয়, সরাসরি রাজনৈতিক কৌশল তৈরির কাজে যুক্ত হয়ে পড়ে। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতিতে ‘নীরব অভিভাবক’ হিসেবে RAW-এর একটি পরিচিতি গড়ে ওঠে। বাংলাদেশেও RAW-এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা দেখা যায় ১৯৭১ সালে। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই সংস্থা সরাসরি অস্ত্র, প্রশিক্ষণ ও গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে সাহায্য করে। স্বাধীনতার পরেও বাংলাদেশে RAW রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশে সক্রিয় থেকেছে। শেখ হাসিনার সরকার ও RAW-এর সম্পর্ক তাই কেবল বন্ধুত্বের নয়, বরং স্বার্থনির্ভর এক জোট হয়ে দাঁড়ায়।

শেখ হাসিনা ও RAW; টিকে থাকার রসায়ন:

২০০৯ সালে ক্ষমতায় ফেরার পর থেকে শেখ হাসিনা একের পর এক নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই ‘বিজয়ী’ হচ্ছেন। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন ছিল বিরোধীশূন্য, ভোটারবিহীন এবং বিতর্কিত। অথচ আন্তর্জাতিক বিরোধিতা সত্ত্বেও ভারতের পক্ষ থেকে হাসিনার সরকার বরাবরই পূর্ণ সমর্থন পেয়ে এসেছে। এই সমর্থনের পেছনে ছিলো RAW-এর স্পষ্ট ভূমিকা।

RAW শেখ হাসিনাকে একটি ‘নির্ভরযোগ্য অংশীদার’ হিসেবে বিবেচনা করে। বাংলাদেশে ভারতের ভূরাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থ রক্ষা করতে শেখ হাসিনা উপযোগী। তাই বিরোধী দল বিএনপি ও জামায়াতকে দমন, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা হরণ, বিচারবহির্ভূত হত্যা এসবকে RAW চোখ বন্ধ করে সমর্থন দিয়েছে। অপরদিকে, গুম ও আয়না ঘরের সাথে  RAW সরাসরি জড়িত।

এছাড়াও, তিস্তার পানির চুক্তি, ট্রানজিট সুবিধা, নিরাপত্তা চুক্তি - এই সবকিছু হাসিনা সরকার ভারতকে দিয়েছে, বিনিময়ে ভারতের রাজনৈতিক সমর্থন ও RAW-এর ছায়া সুরক্ষা পেয়েছে। এর ফলে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে একধরনের ক্ষোভ জন্মেছে, যেখানে ভারতীয় হস্তক্ষেপ ও হাসিনার একদলীয় শাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠে সর্বস্তরের মানুষ ও সামাজিক শক্তিগুলো। যার ফলে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে এক নজিরবিহীন জনরোষ সৃষ্টি হয় বাংলাদেশ, যে গণঅভ্যুত্থানের ফলে শেখ হাসিনা প্রাণের মায়ায় রাষ্ট্রক্ষমতা ছেড়ে RAW-এর ছত্রছায়ায় ও ভারতের সহযোগিতায় নয়াদিল্লিতে পালিয়ে যায়।

নরেন্দ্র মোদি ও RAW- একই সূত্রে গাঁথা রাজনীতি: 

নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই এক নতুন জাতীয়তাবাদী রাজনীতি শুরু করেন। ‘হিন্দুত্ব’ ও ‘নিউ ইন্ডিয়া’ নামক আদর্শে ভর করে মোদি সরকার একটি একদলীয় ও হিন্দু ধর্মীয় রাষ্ট্র নির্মাণের দিকে এগোতে থাকেন। নির্বাচন কমিশন, বিচারব্যবস্থা, পুলিশ, সংবাদমাধ্যম সবকিছুর উপর প্রভাব বিস্তার করে মোদি সরকার একটি 'ম্যানেজড ডেমোক্রেসি' তৈরির চেষ্টা করে। এবং এই গোটা প্রক্রিয়ায় RAW-এর কৌশলগত সহায়তা আছে বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন। কাশ্মীর থেকে ৩৭০ ধারা বাতিল, CAA ও NRC নিয়ে সৃষ্ট সংকট, কৃষক আন্দোলন দমন ইত্যাদি ক্ষেত্রে RAW-এর সহায়তা ও ‘মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ’ কৌশল স্পষ্ট। বিভিন্ন অঞ্চলে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা, ভারতজুড়ে মুসলিম নির্যাতন ও মুসলিম নিধন, তৎপ্রেক্ষিতে সংগঠিত বিভিন্ন  আন্দোলন ও বিদ্রোহ দমনে RAW প্রযুক্তিগত ও গোয়েন্দা সহায়তা দিয়েছে। RAW এর কাছে মোদি সরকারও একটি ‘মূল্যবান মিত্র’, যাঁরা ভারতের অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক স্বার্থ বজায় রাখছেন- চীন, পাকিস্তান, ও উপমহাদেশে আধিপত্য কায়েমে। কিন্তু এই প্রক্রিয়ায় মোদি যেমন মানুষের অধিকার কেড়ে নিচ্ছেন, তেমনি ক্রমশ নিজেই হয়ে উঠছেন এক ‘অতিনির্ভরশীল শাসক’, RAW-এর হাতের পুতুল।

ক্ষমতার মোহ ও জনরোষ- পতনের পূর্বাভাস:

ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, যে শাসকরা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে কেবল গোপন সংস্থার সাহায্যে টিকে থাকতে চান, তাঁদের পতন অবধারিত। শেখ হাসিনা আগেই পালিয়ে দিল্লিতে অবস্থান নিয়েছেন। শেখ হাসিনার আস্থাভাজন মোদিও আজ নিজ দেশের জনগণের আস্থা হারাচ্ছেন। একদিকে বাংলাদেশের তরুণ সমাজ, ইসলামপন্থী ও জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক শক্তি যতটা সোচ্চার হচ্ছে, অন্যদিকে ভারতের মুসলিম, দলিত, কৃষক ও ধর্মনিরপেক্ষ জনগণ মোদি বিরোধিতায় জেগে উঠছে।
RAW-এর অপকৌশলের ধরন:
RAW এর কৌশল তখনই কার্যকর, যতদিন মানুষ চুপ থাকে। কিন্তু যখন গণজোয়ার শুরু হয়, তখন RAW-ও চুপ হয়ে যায়। অতীতে দেখা গেছে, ১৯৭৫ সালে শেখ মুজিব, ১৯৮৯-তে রাজীব গান্ধী, ২০১১ সালে আরব বসন্তের সময় মিশর ও তিউনিশিয়ার স্বৈরাচারী শাসকদের পতনে গোয়েন্দা সংস্থা কিছুই করতে পারে নি।
একইভাবে, জনগণের রোষ অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠায়, RAW শেখ হাসিনাকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয় এবং বর্তমান বাস্তবতায় মোদিকেও রক্ষা করতে পারবে না বলেই প্রতীয়মান হয়। বরং নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় তাঁরা নতুন শক্তিকে সমর্থন দেবে; যেটা অতীতেও RAW করেছে।

RAW-এর পরিকল্পনা ব্যর্থ হলে কী হতে পারে:

যদি RAW-এর ‘প্রক্সি শাসননীতি’ ব্যর্থ হয়, তাহলেও তাদের নিজস্ব কোনো ক্ষতি হবে না। কারণ RAW সরকার পরিবর্তনকে সমস্যা হিসেবে দেখে না, যতক্ষণ পর্যন্ত তা ভারতের স্বার্থে বিঘ্ন না ঘটায়। কিন্তু শেখ হাসিনা বা মোদির মতো নির্ভরশীল নেতাদের জন্য এটি হয় চরম ধাক্কা। বাংলাদেশে একটি গণঅভ্যুত্থান বা রাজনৈতিক ধস দেখা দিলে শেখ হাসিনা ব্যক্তিগত নিরাপত্তার জন্যও ভারতের ওপর নির্ভর করতে বাধ্য হয়, অনেকটা আফগানিস্তানের আশরাফ গনির মতো। অন্যদিকে ভারতে যদি মোদির জনপ্রিয়তা কমে যায় এবং বিরোধী শক্তি ক্ষমতায় আসে, তাহলে মোদি-RAW সম্পর্ক নিয়েও প্রশ্ন উঠবে। RAW তখন এক নেতাকে ফেলে নতুন নেতার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলবে, কিন্তু শেখ হাসিনা বা মোদি তখন আর রাজনীতির দৃশ্যে টিকে থাকতে পারবেন না।

ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ-মোদির ভবিষ্যৎ: সাম্প্রতিক সময়ে ভারত-পাকিস্তানের যুদ্ধাবস্থার কারণে মোদি ইচ্ছাকৃতভাবেই ভারতের ভিতরে দাঙ্গা লাগানোর পাঁয়তারা করছে। এটি এখন হিন্দু ধর্মাবলম্বীরাও বুঝতে পেরেছেন।  কাশ্মীরে মোদি ও RAW- এর ষড়যন্ত্রে যে পর্যটক হত্যা হয়েছে তা অবাধ তথ্য প্রবাহের এই যুগে বিশ্বের কাছে পরিষ্কার। এই ইস্যুকে সামনে নিয়ে পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধাবস্থা ভারতের সাধারণ মানুষ মেনে নিতে পারছে না। ইতোমধ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, তুরস্ক ও ইরান তাদের মন্তব্য ও মতামত পাকিস্তানের পক্ষে সমর্থন জুগিয়েছে। এই অবস্থায় যদি মোদিকে পালাতে হয় তাহলে একমাত্র বাংলাদেশ‌ই তার জন্য নিরাপদ স্থান। সেক্ষেত্রে রাহুল গান্ধী ক্ষমতায় এলে মোদির বিরুদ্ধে বিচার চালু করবে; যেমন বিচার মোদির বান্ধবী হাসিনার ক্ষেত্রে ঢাকায় হচ্ছে। যেহেতু বন্দী বিনিময় চুক্তিতে মোদি হাসিনাকে ঢাকায় প্রত্যর্পণ করেনি, সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ‌ও মোদিকে দিল্লির কাছে হস্তান্তর করবে না। এক্ষেত্রে কংগ্রেস সরকার কর্তৃক মোদির উপর নির্ধারিত বিচার ও শাস্তি দিল্লিতে অবস্থানরত হাসিনার উপরে এবং ঢাকায় আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল কর্তৃক  হাসিনার জন্য নির্ধারিত শাস্তি মোদির উপরে প্রয়োগ করে দক্ষিণ এশিয়ায় সার্ককের কার্যক্রম সুবিস্তৃত করে সুশাসন ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা যায়।

RAW-এর কৌশলগত বুদ্ধিতে দুই দেশের শাসকই এক ধরনের কৃত্রিম নিরাপত্তাবলয়ে আবদ্ধ। জনগণের ভোট, মতপ্রকাশ, প্রতিবাদ- সবকিছুকে উপেক্ষা করে হাসিনা ক্ষমতা চিরস্থায়ী করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তা  সম্ভব হয়নি।

শেখ হাসিনা ও মোদির পথ যেন একই: একদলীয় শাসন, সংবাদমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ, বিরোধী দমন, জঙ্গি নাটক, দাঙ্গা, বাহ্যিক কৌশলের ওপর নির্ভরতা
এবং তাঁদের ভবিষ্যতও সম্ভবত অভিন্ন তা হলো- জনরোষ, আন্দোলন, আন্তর্জাতিক চাপ, পতন।
RAW যতই পরিকল্পনা করুক, শেষ কথা জনগণের। কারণ রাজনীতির আসল শক্তি জনতা, গোপন সংস্থা নয়। নরেন্দ্র মোদি যদি জনগণের কাছে ফিরে না আসেন, তাহলে RAW-এর তৈরি কৃত্রিম সাম্রাজ্য একদিন ভেঙে পড়বে-এবং ইতিহাসে তিনি স্মরণীয় হবেন শেখ হাসিনার মত এক ও অভিন্ন পরিচয়ে: কুখ্যাত গণখুনি ও ঘৃণিত স্বৈরাচার।

লেখক: কলামিস্ট ও রাজনীতি বিশ্লেষক।

banner close
banner close