রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগে ২০২৩ সালে প্রকাশিত আওয়ামী ঘরানার একটি বিতর্কিত সার্কুলারের ভিত্তিতে তড়িঘড়ি করে শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া চালানোর চেষ্টা এবং সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকায় একাধিক নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ নেতার নাম থাকার অভিযোগ উঠেছে। অভিযুক্তদের মধ্যে অন্যতম হলেন শহীদ হবিবুর রহমান হল শাখা ছাত্রলীগের তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক সাজ্জাদুর রহমান।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তিনি ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের ২০১৩-১৪ সেশনের শিক্ষার্থী ছিলেন। ২০১৮ সালে তাঁর স্নাতকোত্তর শেষ হলেও ২০২৪ সাল পর্যন্ত একটি দীর্ঘসময় পযর্ন্ত ছাত্রলীগের অবৈধ ক্ষমতায় হলের আবাসন সুবিধা নেন। শিক্ষক হবার উদগ্র বাসনায় ছাত্রলীগের সন্তুষ্টির অর্জনই ছিলো তার প্রধান লক্ষ্য। নিজের লক্ষ্য অর্জনে তিনি জোরপূর্বক শিক্ষার্থীদেরকে ছাত্রলীগের মিটিং-মিছিলে বাধ্য করতেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এমনকি চলমান নিয়োগ প্রক্রিয়ায় তিনি ২০২৩ সালের আবেদনপত্রের সঙ্গে ছাত্রলীগের দলীয় প্যাডে সুপারিশ, প্রত্যয়নপত্র ও অবৈধ তদবির সংযুক্ত করেছিলেন। সূত্র জানায়, পাঁচ আগস্ট সরকার পতনের পর তিনি বিভাগের এক প্রভাবশালী শিক্ষকের সহায়তায় এসব দলীয় কাগজপত্র গোপনে সরিয়ে নেন।
সহপাঠীদের দাবি, জুলাই আন্দোলনের সময়ে তিনি ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পক্ষে সক্রিয়ভাবে ফেসবুকে লিখলেও সরকার পতনের পর নিজের বিতর্কিত ভূমিকাকে আড়াল করতে ফেসবুক আইডি ডিএক্টিভেট করেছেন।
তাছাড়া সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকায় আফতাবুজ্জামান রনির নামের আরেক নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ কর্মীর নামও উঠে এসেছে। অভিযোগ রয়েছে, অবৈধ উপায়ে চাকরি নিশ্চিত করার শর্তে তিনি আওয়ামীপন্থী শিক্ষকনেতা সাবেক প্রো-ভিসি সুলতান উল ইসলামের মেয়েকে বিয়ে করেছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধেও শের-ই-বাংলা হলে ছাত্রলীগের প্রভাবে রুম দখলসহ বেশকিছু অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে।
নিয়োগ কার্যক্রমের সাথে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রের বরাতে জানা যায়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগে ২০২৩ সালে শিক্ষক নিয়োগের জন্য এই সার্কুলারটি দেওয়া হয়েছিল। সর্বস্তরে আওয়ামী দলীয়করণের প্রেক্ষাপটে মতাদর্শের বাইরে কারোপক্ষে নিয়োগ পাওয়া ছিলো তখন খুবই দুরহ ব্যাপার। যেকারণে সকল যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও নিয়োগের জন্য আবেদন করার আগ্রহ পায় নি অনেকে। তাছাড়া সার্কুলার প্রকাশের আগে ও পরে রাবি প্রশাসনের দুর্নীতির অভিযোগে রাবির নিয়োগের উপর কয়েক দফায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। ফলে ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের নিয়োগ কার্যক্রমটিও স্থগিত ছিলো। ২০২৪ সালে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হলেও গণঅভ্যুত্থানের পর নতুন প্রেক্ষাপটে অনেকেই আশা করেছিলেন, পুরোনো সার্কুলার বাতিল করে নতুন সার্কুলার দেয়া হবে, যাতে আগের মতো সুযোগ বঞ্চনা না ঘটে।
কিন্তু অভিযোগ ওঠেছে, বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থ হাসিলে পুরাতন সার্কুলারের ভিত্তিতেই ৪১ জন আবেদনকারীর মধ্য থেকে ২০২৫ সালের শুরুতে বিভাগটি তড়িঘড়ি করে নিয়োগ বোর্ড সম্পন্ন করে এবং ছয়জন সম্ভাব্য প্রার্থীকে বাছাই করে। তবে প্রকৃত মেধা না দেখে স্বজনপ্রীতি ও রাজনৈতিক ঘনিষ্ঠতাকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ করেন বঞ্চিতরা। বিতর্কিতরা নিয়োগ পেলে সেটা জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের শহিদদের রক্তের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা হবে বলে দাবি তাদের।
তবে বিভাগ ও বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের দাবি, বিভাগে শিক্ষক সংকট রয়েছে। বিভাগের স্বার্থে পুরাতন এই নিয়োগ কার্যক্রমটা দ্রুত সম্পন্ন হওয়া জরুরি। এতে কেউ বঞ্চিত হচ্ছে না। পরবর্তী সার্কুলারে শর্ত পূরণ সাপেক্ষে সবাই আবেদন করতে পারবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন সম্ভাব্য প্রার্থী নিজেদের হতাশার কথা জানান। একজন বলেন, ‘আমি অনার্স এবং মাস্টার্সে আমাদের ফ্যাকাল্টিতে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট হয়ে স্বর্ণপদক পেয়েছিলাম। এ ছাড়া আমাদের বিভাগের ইতিহাসে আমার মার্কসও সব থেকে বেশী বলে আমি মনে করি। এরপরও বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান নিয়োগ নীতিমালা অনুযায়ী আমি শিক্ষক হিসেবে আবেদন করতে অযোগ্য। কারণ আমার এসএসসির ফলাফল জিপিএ চার দশমিক ৫০ এবং এইচএসসির ৪.০০। কিন্তু নীতিমালায় চার দশমিক ৫০ শর্ত দেয়া আছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ নীতিমালা সংস্কারের জন্য বর্তমান প্রশাসন একটি কমিটি গঠন করেছে। এই কমিটির রিপোর্ট বাস্তবায়নের পরে পুনরায় সার্কুলার দিয়ে শিক্ষক নিয়োগ দিলে হয়তো আমার মতো অনেকেই আবেদন করতে পারতেন। ২০২৩ সালের সার্কুলারের নিয়োগ বোর্ড ২০২৫ এর মার্চে অনুষ্ঠিত হলো। দুইবছর যেহেতু অপেক্ষা করা সম্ভব হয়েছে, সেহেতু নীতিমালা সংস্কার কমিটির রিপোর্ট দেয়া পর্যন্ত আর কিছুদিন কি অপেক্ষা করা যেতো না? আমি মনে করি দুরভিসন্ধিমূলকভাবে কাজটি করা হয়েছে। বর্তমান নিয়োগ নীতিমালা উপযুক্ত নয় বলেইতো সেটা সংস্কারের জন্য কমিটি গঠন করা হয়েছে। তাহলে কেনো তড়িঘড়ি করে এই বোর্ডটি করা হলো?’
আরেক সম্ভাব্য প্রার্থী বলেন, ‘বর্তমান নীতিমালা বিগত সরকারের সময়ে করা হয়েছিল। তাছাড়া, সার্কুলারটাও ২০২৩ সালের। ওই সময়ের প্রেক্ষাপটে আমার মত অনেকেই ধরে নিয়েছিল যে আবেদন করে লাভ নেই। ৫ আগস্টের পরে আমাদের প্রত্যাশা ছিল, নতুন প্রশাসন নীতিমালা সংস্কার করে নতুন একটা সার্কুলারের মাধ্যমে নিয়োগ দিবে। সেটা না করে বর্তমান প্রশাসন গোপনে এবং তড়িঘড়ি করে নিয়োগ বোর্ড সম্পন্ন করেছে। এখন এখানে হয়তো কোনো গোপন ব্যাপার রয়েছে। কারো পছন্দের প্রার্থী থাকতে পারে। এর ফলে আমার মত অনেকেই বঞ্চিত হয়েছে।’
অন্যদিকে সব অভিযোগ নাকচ করে অভিযুক্ত ছাত্রলীগ নেতা সাজ্জাদুর রহমান বলেন, ‘আমাকে ছাত্রলীগে পদ দেওয়া হয়েছে এটা আমি আগে জানতাম না। আমার অজ্ঞাতসারে দিয়েছে। পরে জেনেছি। ২০১৮ সালে আমার মাস্টার্স শেষ হলেও রেজাল্ট প্রকাশ হয় ২০২১ সালে। তারপর ২২-২৩ সেশনে এমফিলে ভর্তি হই। সুতরাং আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে অবৈধভাবেও ছিলাম না।’
জুলাই অভ্যুত্থানে ছাত্রলীগের সহিংস কার্যক্রমকে সমর্থন জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লেখালেখির অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি তা অস্বীকার করে বলেন, ‘আসলে গাজা ইস্যুতে পোস্ট দেয়ার কারণে ফেসবুক আমার আইডি রেস্ট্রিকটেড করেছে। ফেসবুক ডিএক্টিভেট করার অন্য কোনো কারণ নাই।’
তাহলে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ-আ.লীগ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে দন্ডিত শেখ হাসিনার বিচার চান কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘হ্যাঁ চাই। অবশ্যই চাই।’
অন্যদিকে তার কয়েকজন সহপাঠী মন্তব্য করেছেন, ‘যে ব্যক্তি নিজের স্বার্থে যেকোনো কিছু করতে পারে, যার ব্যক্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে, এমন মানুষ শিক্ষক হওয়ার যোগ্য কিনা, তা নিয়েই আমাদের সন্দেহ আছে। আমরা তো তাকে মানুষ হিসেবেও মনে করি না।’
জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী সংস্কারকালীন এই গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এসে আওয়ামী শাসনামলে প্রকাশিত ২০২৩ সালের পুরাতন সার্কুলারটি সংশ্লিষ্ট বিভিন্নপক্ষের দাবির প্রেক্ষিতে রিসার্কুলার করার দরকার আছে কিনা জানতে চাইলে ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. ইউনুস আহমেদ খান বলেন, ‘এই বিষয়ে আমি কিছুই বলতে পারবো না। এখানে বিভাগের কোনো বক্তব্য নাই, বিভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনানুযায়ী চলে। নিয়োগ প্রক্রিয়া বা যেকোনো প্রক্রিয়াতে বিভাগের আলাদা করে কিছু বলার সুযোগ নাই। আপনি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সাথে যোগাযোগ করেন প্লিজ।’
একই প্রশ্নের জবাবে বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য অধ্যাপক সালেহ হাসান নকীব বলেন, ‘আগে যে সার্কুলারগুলো হয়েছে প্রত্যেকটি ভ্যালিড সার্কুলার। কাজেই আইনগত দিক থেকে কোনো সমস্যা নাই।’
সম্ভাব্য প্রার্থী তালিকায় নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের একাধিক নেতার নাম থাকার অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি জানান, ‘এগুলো এখনো সিন্ডিকেটে আসেনি। সবদিক যাচাই-বাছাই করেই অনুমোদন করা হবে।’
আরও পড়ুন:








