প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস। প্রকৃতি হাতছানি দিয়ে ডাকে, হারাতে ইচ্ছে হয় পাহাড়ি নদীর বাঁকে, দূর্গম পথ পেরিয়ে পাহাড় জয়ের নেশা, প্রকৃতির একান্ত সান্নিধ্যে নিজেকে ভালোবাসা। আপনি যদি এমন প্রকৃতির প্রেমে পড়তে চান, তাহলে আপনার চোখে ধরা দিবে চবির নয়নাভিরাম সৌন্দর্য। পাহাড়, সমতলের অপরূপ প্রকৃতি একাকার হয়ে মিশে আছে এই ক্যাম্পাসে। হাজারো স্বপ্ন প্রতিনিয়ত প্রস্ফুটিত হয়ে জয় করে নিচ্ছে জীবনের সুমহান সান্নিধ্য। শুধু সৌন্দর্য নয়, গৌরব আর অর্জনে প্রতিনিয়ত এগিয়ে যাচ্ছে এই ক্যাম্পাস।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ১৯৬৬ সালে মাত্র ২০০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে পথচলা শুরু করে আজ স্বপ্ন দেখাচ্ছে ২৮ হাজার শিক্ষার্থীকে। এই ক্যাম্পাসের যাত্রীরা শুধু স্বপ্ন অর্জনে থেমে নেয়, প্রতিনিয়ত এগিয়ে আসে দেশের সংকটকালীন সময়ে। যখনই দেশের ভাগ্যাকাশে ঘন কালোমেঘ জমাট বাঁধে তখনই এই ক্যাম্পাসের যাত্রীরা বীররূপে দাঁড়িয়ে যায়। এগিয়ে আসে দেশমাতৃকার অস্তিত্ব রক্ষায়। এভাবেই মহান মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে চব্বিশের জুলাই আন্দোলনে রক্ত দিয়েছে স্বপ্নের যাত্রীরা। ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিখে রেখেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম।
হাজারো ঘাত-প্রতিঘাতকে পেরিয়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এই ক্যাম্পাস। সেই ১৯৬৬ সালের কথা। পূর্বে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছিল বঙ্গদেশে। পূর্ববঙ্গের শিক্ষানুরাগীরা প্রতিবাদ গড়ে তুলেন দেশের তৃতীয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য। প্রস্তবনায় আসে কুমিল্লা, সিলেট ও চট্টগ্রামের নাম। এই তিনজেলার পন্ডিতগণই যুক্তি তুলে ধরেন নিজ নিজ জেলার পক্ষে। তবে এখানে আলোকবর্তিকারূপে আবর্তিত হয় ফজলুল কাদের চৌধূরী। অবিভক্ত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের অনুপস্থিতিতে ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পেয়েছিলেন তিনি। এই সুযোগে নিজ জেলায় কার্যকর করে নেয় দেশের তৃতীয় বিশ্ববিদ্যালয় তথা আজকের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। একইসাথে কার্যকর করে নেয় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বাজেট।
তবে এই সুজলা সুফলা ক্যাম্পাসের ঠাঁই হয়নি শহরের বুকে। শহর থেকে প্রায় ২২ কিলোমিটার উত্তরে পাহাড়ের পাদদেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এই ক্যাম্পাস। যদিও প্রথমদিকে প্রস্তাব করা হয়েছিল শহরের চট্টগ্রাম কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা। অন্য এক প্রস্তাবে বলা হয়েছিল, শহরের ফুসফুস খ্যাত সিআরবি এলাকায় এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু সব প্রস্তাবকে অকার্যকর করে আইয়ুব সরকার এই বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রতিষ্ঠা করলেন শহরের অদূরে এক গ্রামে। এর কারণস্বরূপ তৎকালীন চবি অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ও বর্তমান সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তাঁর ‘গ্রামীণ ব্যাংক ও আমার জীবন’ নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেন, “ছাত্রসমাজের প্রতি আইয়ুব সরকারের মনোভাব ছিল বিরূপ। তিনি ভাবতেন ছাত্ররাই যত গন্ডগোলের মূল। এই আশঙ্কায় তিনি সব বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন শহর থেকে বহু দূরে। যাতে ছাত্রদের রাজনৈতিক বিক্ষোভ জনবহুল শহর অঞ্চলের শান্তি বিকৃত না করে। এই উদ্দেশ্য সামনে রেখেই তিনি জোবরা গ্রামকে বেছে নিয়েছিলেন।” এভাবেই গ্রামে গড়ে উঠতে থাকে আজকের স্বপ্নের চবি ক্যাম্পাস।
শুরুর দিকে যেমন ছিল চবি ক্যাম্পাস:
বর্তমান আইন অনুষদ তৎকালীন রাজবাড়ীয়া টিলাকে কেন্দ্র করে প্রসারিত হতে থাকে চবি ক্যাম্পাস। টিলার মাঝখানে সমান করে তোলা হয় দুতলা বিশিষ্ট প্রশাসনিক ভবন। এর দক্ষিণে সব বিভাগের ক্লাসের জন্য চার কক্ষ বিশিষ্ট একটি ব্লক এবং তার দক্ষিণে বিভাগীয় অফিস ও গ্রন্থাগারিকের অফিস করা হয়। আজ থেকে ঠিক ৬০বছর আগে অর্থাৎ ১৯৬৬ সালের ১৮ নভেম্বর শুধু বাংলা, ইংরেজি, ইতিহাস ও অর্থনীতি- চারটি বিভাগ দিয়ে যাত্রা শুরু করে চবি ক্যাম্পাস। যেখানে ছিল মাত্র ৭ জন শিক্ষক ও ২০০ শিক্ষার্থী।
চবির ইতিহাস বিভাগের তৎকালীন অধ্যাপক আবদুল করিম ‘সমাজ ও জীবন’ নামক গ্রন্থে লেখেন, “১৯৬৬ সালের ২৮ নভেম্বর সব বিভাগের ক্লাস শুরু হয়। একই বছরের অক্টোবরের মধ্যে ৪টি বিভাগে দুইজন করে শিক্ষক, একজন করে রেজিস্ট্রার ও গ্রন্থাগারিক নিযুক্ত করা হয়। সর্বপ্রথম ইতিহাস বিভাগে রিচার্স পেলোর পদ সৃষ্টি করা হয়।” এভাবে হাঁটি হাঁটি পা পা করে স্বপ্নের জোড়াতালি দিতে দিতে আজকের চবির অবস্থান। যা বর্তমানে হাজারো স্বপ্নকে ধারণ করে এক নতুন আবহ তৈরি করেছে।
বর্তমানে বিশ্ববিদ্যালয়ে ১০টি অনুষদ, ৪৮টি বিভাগ, ৬টি ইনস্টিটিউট রয়েছে। অধ্যয়ন করছেন প্রায় ২৮ হাজার শিক্ষার্থী, রয়েছে ৯২০ জন শিক্ষক। শিক্ষার্থীদের থাকার জন্য রয়েছে ১৩টি আবাসিক হল (ছেলেদের ৮টি, মেয়েদের ৫টি) ও একটি ছাত্রাবাস।
মহান মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা:
বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার মাত্র কয়েক বছরের মধ্যে তুমুল হয়ে উঠে স্বাধীনতা আন্দোলন। দানা বাধতে শুরু করে মুক্তির সংগ্রাম আন্দোলন। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। যুদ্ধের শুরুর দিক থেকেই একীভূত হতে থাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বুদ্ধিজীবীরা। মহান স্বাধীনতা ঘোষণার ঠিক তিন দিন পূর্বে অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ চট্টগ্রাম শহরের প্যারেড ময়দানে এক বিশাল জনসভার আয়োজন হয়। যেখানে চবির প্রথম এবং তৎকালীন উপাচার্য (ভিসি) প্রফেসর মল্লিক বক্তৃতায় ঘোষণা দেন, “আজ থেকে আমি আর উপাচার্য নেই। দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত একজন মুক্তি সংগ্রামী হিসেবে আমি নিজেকে মনে করব।” শুধু তাই নই একই মাসের ১৭ তারিখ থেকে শহরের লালদীঘি ময়দানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির নেতৃত্বে সপ্তাহব্যাপী বক্তৃতা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের অবদান ছিল মূলত যুদ্ধের যৌক্তিকতা বিশ্বের দরবারে তুলে ধরার প্রয়াস। এখানেই থেমে থাকেনি চবির কৃতিত্ব। সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধেও লড়াকু ভূমিকা পালন করেন চবির শিক্ষার্থীরা। যেখানে প্রাণ হারায় চবি পরিবারেরর ১৬ জন সদস্য। যাদের ত্যাগ আর বিসর্জনে আজও স্মৃতিতে অম্লান হয়ে আছে এই ক্যাম্পাসের কৃতিত্ব।
মহান মুক্তিযুদ্ধে চবি থেকে যারা প্রাণ হারান:
দীর্ঘ নয়মাস স্বাধীনতার যুদ্ধে রক্তে রঞ্জিত হয় চবি ক্যাম্পাসের ১৬ জন শহীদ। তারা হলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রকৌশল দপ্তরের চেয়ারম্যান বীর প্রতীক মোঃ হোসেন, দর্শন বিভাগের খন্ডকালীন শিক্ষক অবনী মোহন দত্ত, চাকসুর সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও ইতিহাস বিভাগের ছাত্র আব্দুর রব এবং একই বিভাগের শিক্ষার্থী ফরহাদ উল্ল্যাহ মোঃ এজজহারুল ইসলাম। এছাড়া বাংলা বিভাগের ছাত্র মনিরুল ইসলাম খোকা, মোহাম্মদ হোসেন ও মোস্তফা কামাল। তালিকায় রয়েছেন অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র আব্দুল মান্নান, বাণিজ্য অনুষদের ছাত্র খন্দকার এহসানুল হক আনসারী, ইংরেজি বিভাগের ছাত্র আশুতোষ চক্রবর্তী, রাজনীতি নাজিম উদ্দিন ও আবুল মনসুর। একইসাথে শহীদের তালিকায় রয়েছেন গণিত বিভাগের ছাত্র ভুবন ও আলাওল হলের প্রহরী সৈয়দ আহমেদ।
২০২৪ এর জুলাই বিপ্লবে চবি শিক্ষার্থীদের কৃতিত্ব:
যুগে যুগে প্রতিটি আন্দোলন সংগ্রামে সম্মুখ সারি থেকে নেতৃত্ব দিয়ে গেছেন চবির বীরপুরুষরা। কখনো কখনো রক্ত দিয়ে কিনে নিয়েছেন নিজেদের স্বাধীনতাকে। এমনকি কথা বলার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতেও বদ্ধপরিকর ছিলেন এই ক্যাম্পাসের স্বপ্নবাজ শিক্ষার্থীরা। সর্বশেষ জুলাই আন্দোলনে ফ্যাসিস্ট সরকারের সামনে দাবানল হয়ে দাঁড়ায় এই ক্যাম্পাসের তরুণরা। জুলাই আন্দোলন যখন তুঙ্গে পুরোদেশ তখনই চট্টগ্রাম শহরে আন্দোলনের এক আবহ সৃষ্টি করে এই ক্যাম্পাসের শিক্ষার্থীরা। পুরো চট্টগ্রাম শহরকে আন্দোলনে মুখর করে রাখে এই ক্যাম্পাসের স্বপ্নবাজরা। তখন পুরো বাংলাদেশের মধ্যে চট্টগ্রাম শহরের আন্দোলনে অচল হয়ে পড়ে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা সরকারের মসনদ। হাসিনা সরকারের দমন নিপীড়নের ফলে জুলাই বিপ্লবে প্রাণ হারায় চবির ইতিহাস বিভাগের দুজন শিক্ষার্থী। শহীদ হৃদয় চন্দ্র তরুয়া ছিলেন বিভাগের তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী। একইসাথে শহীদের কাতারে সামিল হন একই বিভাগের শহীদ মোহাম্মদ ফরহাদ হোসেন। তাদের রক্ত রঞ্জিত হয়ে যায় বাংলার মাটি। সর্বশেষ ২৪ এর ৫ই আগস্ট পালাতে বাধ্য হয় ফ্যাসিস্ট সরকার শেখ হাসিনা।
আরও পড়ুন:








