চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে (চবি) অধ্যয়নরত বহু শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত তথ্য গোপনে একটি প্রতারক চক্র হাতিয়ে নিয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। মুঠোফোনে কল দিয়ে নিজেকে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা পরিচয় দিচ্ছেন প্রতারক চক্রের সদস্যরা। এসময় শিক্ষার্থীদের হয়রানি এবং আর্থিক লেনদেনের জন্য প্রলোভন দেখাচ্ছে প্রতারক চক্রটি।
অভিযোগ রয়েছে, বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃত্তিপ্রাপ্ত সকল শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত গোপনীয় তথ্য চক্রটি ইতিমধ্যে জব্দ করেছে। তাদের কাছে শিক্ষার্থীদের মোবাইল নাম্বার ও ব্যাংক একাউন্টসহ যাবতীয় তথ্য চলে গেছে। প্রতারক চক্রের সঙ্গে জড়িত সদস্যরা বিভিন্ন মোবাইল নাম্বার দিয়ে শিক্ষার্থীদেরকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলার চেষ্টা করছেন।
বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) একাধিক বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীকে কল দিয়ে প্রতারিত করার অভিযোগ উঠেছে। অনুসন্ধানে এসব অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে।
প্রতারক চক্রের সদস্যরা মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদেরকে লক্ষ্য করে তাদের কাজ পরিচালনা করছে। এক্ষেত্রে তাদেরকে মুঠোফোনে কল দিয়ে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের কর্মকর্তা পরিচয়ে ব্যক্তিগত বিভিন্ন তথ্য বলে বিশ্বাস অর্জনের মাধ্যমে প্রতারণার চেষ্টা করছে চক্রটি। তাছাড়া চক্রের সদস্যরা শিক্ষার্থীদের ব্যাংকের হিসাব নম্বর, ব্যাংকের হিসাব, এটিএম কার্ডের নাম্বারসহ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ফাঁস করে দিচ্ছে।
প্রতারক চক্রের সদস্যদের এমন ধারাবাহিক প্রতারণা চেষ্টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। শিক্ষার্থীদের ব্যক্তিগত গোপনীয় তথ্যের প্রবেশাধিকার যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কাছে সংরক্ষিত তাই শিক্ষার্থীদের সন্দেহের তীর সেদিকেই। এক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কর্মকর্তা/কর্মচারী একাজে সরাসরি জড়িত থাকতে পারে বলে সন্দেহ প্রকাশ করছেন শিক্ষার্থীদের অনেকেই। কেননা এমন নির্ভুল তথ্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের সংশ্লিষ্টদের কাছে ব্যতীত প্রতারক চক্রের কাছে থাকা সম্ভব না। তবে কিভাবে এমন জনগুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি ফাঁস হয়ে প্রতারক চক্রের কাছে গেল তা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন শিক্ষার্থীরা। প্রতারক চক্রটি অধিকাংশ শিক্ষার্থীকে একটি নাম্বার থেকে কল দিয়ে প্রতারণার চেষ্টা করছে। নাম্বারটি হলো +8801347038242। অন্য আরেকটি নাম্বার ‘+8801340905036’ থেকে প্রতারণা করার প্রমাণ পাওয়া গেছে৷
প্রতারক চক্রের একজন সদস্য মুঠোফোনে ইতিহাস বিভাগ ২০২৩-২৪ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ আমিন উদ্দিনের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। নিজেকে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তা পরিচয় দিয়ে কথা শুরু করেন প্রতারক চক্রের ওই সদস্য। ওই শিক্ষার্থীর বিশ্বাস অর্জনের জন্য তার ব্যক্তিগত বিভিন্ন তথ্য বলতে শুরু করেন। প্রতারণাপূর্ণ বক্তব্য সন্দেহে মোবাইল কেটে দেন তিনি। জানতে চাইলে আমিন উদ্দিন বলেন, “আমাকে একটি অপরিচিত নাম্বার থেকে কল দিয়ে আমার ব্যক্তিগত সব তথ্য তিনি অকপটে বলতে থাকেন। তিনি আমার কাছ থেকে এটিএম কার্ডের নাম্বার চায়। আমি ওনার কথা শুনেই বুঝতে পেরেছিলাম এটি একটি প্রতারণা। প্রতারক বুঝতে পেরে আমি কল কেটে দিই।”
এমন প্রতারণাপূর্ণ কল পেয়ছেন আরেক শিক্ষার্থী মুবিন সরকার। ময়মনসিংহ শিক্ষা বোর্ড থেকে পাশ করা এই শিক্ষার্থী ২০২৩-২৪ সেশনের ইতিহাস বিভাগে পড়াশোনা করছেন। মুঠোফোনে প্রতারক চক্রের সদস্য তার পারিবারিক বিভিন্ন তথ্য বলতে থাকেন। ওই প্রতারক নিজেকে চট্টগ্রাম বোর্ডের একাউন্ট অফিসার পরিচয় দিয়ে তার ব্যাংক হিসাবের তথ্য হাতিয়ে নিতে চেষ্টা করেন। তার ব্যাংক হিসাবে সরকারি বৃত্তির টাকা এসেছে বলে তাকে ধোঁকা দেওয়ার প্রচেষ্টা চালান। জানতে চাইলে মুবিন সরকার বলেন, “প্রতারক চক্র আমাকে কল দিয়ে সরকারি বৃত্তি পাওয়ার কথা বলে আমার ব্যাংক হিসাব সম্পর্কে জানতে চায়। সে নিজেকে চট্টগ্রাম বোর্ডের কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দেয়। প্রতারণা বুঝতে পেরে আমি কল কেটে দিই।”
প্রতারক চক্রের হয়রানি শিকার হয়েছেন বাংলা বিভাগের ২০১৬-১৭ সেশনের এক শিক্ষার্থী। মেধাতালিকা ভিত্তিতে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্কলারশিপ পাওয়া এই শিক্ষার্থী নাম মোহাম্মদ সাদ্দাম হোসেন। সাধারণ শিক্ষার্থীদের এমন গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাদি ফাঁস হয়ে কিভাবে প্রতারক চক্রের কাছে গেল তা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন তিনি। একাজে চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ডের কোনো কর্মকর্তা বা চট্টগ্রাম বিশ্বিবদ্যালয়ের সংশ্লিষ্ট কেউ থাকতে পারে বলে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন তিনি। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ”আমার মোবাইলে একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আসছে। তাদের কাছে আমাদের সকল তথ্য রয়েছে, তাই বিশ্বাস করার প্রবণতা অনেক বেশি হতে পারে। হয়তো চট্টগ্রাম শিক্ষা বোর্ড বা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কর্মকর্তা/কর্মচারী একাজে সরাসরি জড়িত, নয়ত এত নির্ভুল তথ্য বলা তাদের পক্ষে সম্ভব না।”
চট্টগ্রাম বিশ্বিবদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের একাডেমিক ও ব্যক্তিগত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক শাখায় সংরক্ষিত থাকে। এক্ষেত্রে তথ্য সংরক্ষণসহ পুরো প্রক্রিয়ায় সমন্বয় করে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইসিটি সেল।
জানতে চাইলে একাডেমিক শাখার ডেপুটি রেজিস্ট্রার এস এম আকবর হোছাইন বলেন, “বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল বৃত্তি প্রাপ্ত শিক্ষার্থীর তথ্য আমরা শিক্ষামন্ত্রণালনয়ে পাঠাই। মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের একটি বিশেষ সার্ভারে আমরা তথ্যগুলো ইনপুট করি।” প্রতারক চক্রের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমাদের সংশ্লিষ্ট কেউ এই চক্রের সাথে জড়িত নেই। বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের তথ্যগুলো সবসময় একটি চক্র হ্যাকড করে থাকে। যারা শুধু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় নই, পুরো দেশের বৃত্তিপ্রাপ্ত শিক্ষার্থীদের তথ্য জব্দ করে।”
এবিষয়ে আইসিটি সেলের পরিচালক অধ্যাপক সাইদুর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। পরে আইসিটি সেলের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ খাইরুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। মুঠোফোনে তিনি বলেন, “শিক্ষার্থীদের বৃত্তির তথ্যগুলো একাডেমিক সেকশনে সংরক্ষিত থাকে। যখন শিক্ষার্থীদের তথ্যগুলো ইনপুট করা হয় তখন একাডেমিক সেকশন আইসিটি সেলের সাহায্য নেয়। তবে এখানে আইসিটি সেল তথ্যগুলো সংরক্ষণ করে রেখে দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই।”
আরও পড়ুন:








