সোমবার

২৯ ডিসেম্বর, ২০২৫ ১৪ পৌষ, ১৪৩২

স্কুলের চাকুরী হারালেন ভুয়া সনদধারী আওয়ামী লীগের নেত্রী

কুষ্টিয়া প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ৫ অক্টোবর, ২০২৫ ১৯:৩৬

আপডেট: ৫ অক্টোবর, ২০২৫ ১৯:৩৬

শেয়ার

স্কুলের চাকুরী হারালেন ভুয়া সনদধারী আওয়ামী লীগের নেত্রী
ফাইল ছবি

দীর্ঘ একবছরের বেশী সময় ধরে যাচাই বাছাই শেষে জাল সনদে চাকুরীর অপরাধে কুষ্টিয়া কালেক্টরেট স্কুল এন্ড কলেজের সহকারী প্রধান শিক্ষক আফরোজা আক্তার ডিউকে চাকুরী থেকে স্থায়ীভাবে অপসারণ করা হয়েছে। রোববার (৫ অক্টোবর) কুষ্টিয়া কালেক্টরেট স্কুল এন্ড কলেজের কার্যনির্বাহী সভায় এই সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়। এছাড়াও বিগত একযুগের বেশী সময় চাকুরীরত অবস্থায় প্রতিষ্ঠান থেকে বেতন ও ভাতা বাবদ যেই অর্থ আফরোজা আক্তার ডিউ নিয়েছেন, সেই অর্থ ফেরৎ পেয়ে আইনগত প্রক্রিয়া গহণ করা হচ্ছে বলেও জেলা প্রশাসন এবং কালেক্টরেট স্কুল এন্ড কলেজ কর্তৃপক্ষ নিশ্চিত করেছেন।

গত বছরের ৫ ই আগস্ট বৈষম্য বিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পত হলে কুষ্টিয়া থেকে স্বপরিবারে পালিয়ে যান আফরোজা আক্তার ডিউ ও তার স্বামী জাল সনদধারী রাশেদুল ইসলাম বিপ্লব। হত্যা মামলা সহ স্ট বৈষম্য বিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলনে একাধিক হত্যা চেষ্টা মামলার আসামী এই দম্পতি। এছাড়াও এই দম্পতির বিরুদ্ধে কুষ্টিয়ার বিভিন্ন থানায় প্রায় হাফ ডজন প্রতারণার মামলা রয়েছে।

জানা যায়, কুষ্টিয়া জেলা মহিলা আওয়ামীলীগের সাংগাঠনিক সম্পাদক আফরোজা আক্তার ডিউ স্নাতক ও মাস্টার্স এর জাল সনদ দিয়ে কুষ্টিয়া কালেক্টরেট স্কুল এন্ড কলেজে সহকারী প্রধানশিক্ষক পদে দীর্ঘ এক যুগের চাকুরীরত। জাল সনদে চাকুরীর বিষয়টি দীর্ঘদিন ধরে গোপন থাকলেও কালেক্টরেট স্কুল এন্ড কলেজের দুই শিক্ষকের দেওয়া তথ্য বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে। আফরোজা আক্তার ডিউ কুষ্টিয়া শহরের পূর্ব মজমপুর এলাকার মৃত সোহরাব হোসেনের মেয়ে ও কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামীলীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক রাশেদুল ইসলাম বিপ্লবের স্ত্রী।

এদিকে এই বিষয়ে গতবছরের ১৪ আগস্ট (বুধবার) জেলা প্রশাসক বরাবর জাল সনদ সনাক্ত পূর্বক যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদন করেন আব্দুস সবুর এক যুবক। সে কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার ফিলিপনগর ইউনিয়নের পূর্ব ফিলিপনগর গ্রামের মৃত আফতাব উদ্দিনের ছেলে। জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিত ঐ আবেদন সুত্রে জানা যায়, আফরোজা আক্তার ডিউ দীর্ঘ দিন যাবত দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয়ের জাল সার্টিফিকেট দিয়ে শিক্ষকতা করে আসছেন।

সে কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী মহিলা লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক হওয়ার কারণে এতদিন কেউ তার বিরুদ্ধে কোন কথা বলতে বা অভিযোগ করতে পারেন নাই। সেই কারণে তার বিরুদ্ধে স্কুল কর্তৃপক্ষের পক্ষ থেকে কোন প্রকার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয় নাই। এছাড়াও সে নিয়মিত স্কুলে উপস্থিত না থেকে তার ক্ষমতার অপব্যবহার করে স্কুলে নিয়মিত হাজিরা প্রদান করে অবৈধ পন্থায় নিয়মিত বেতন ভাতা উত্তোলন করে নিয়ম বর্হিভূত অনিয়ম করেছেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, আফরোজা আক্তার কুষ্টিয়া সরকারী কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করার পর ওই একই কলেজে ইংরেজী বিভাগে অনার্স ভর্তি হন। অনার্স এ তৃতীয় বিভাগ নিয়ে পাস করেন। আবেদনকারী ঐ যুবক আফরোজা আক্তার ডিউর সার্টিফিকেট পরীক্ষাসহ অত্র বিদ্যালয়ে অবৈধ পন্থায় চাকুরীকালীন সময়ে বেতন ভাতা বাবদ প্রদত্ত অর্থ সরকারের কোষাগারে ফিরিয়ে নিতে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসককে অনুরোধ জানান।

এদিকে অনুসন্ধান বলছে, আফরোজা আক্তার কুষ্টিয়া সরকারী কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করার পর ওই একই কলেজে ইংরেজী বিভাগে অনার্স ভর্তি হন। অনার্স এ তৃতীয় বিভাগ নিয়ে পাস করেন।

২০১২ সালের ১৮ই অক্টোবর তৎকালীন সময়ের কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক বনমালী ভৌমিক কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসকের কার্যালয় প্রাঙ্গনে কালেক্টরেট স্কুল এন্ড কলেজ প্রতিষ্ঠিত করেন। তৎকালীন কুষ্টিয়া-৩ আসনের সংসদ সদস্য মাহবুবউল আলম হানিফ প্রতিষ্ঠানটির ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন করেন।তৎকালীন সচিব এনআই খান একাডেমিক ভবন উদ্বোধন করেন।

চাকুরীরত অবস্থায় আফরোজা আক্তার ডিউ বিনা বিরুদ্ধে সহকর্মীদের সাথে গালমন্দ করা সহ ছিলো নানান অভিযোগ। শিক্ষকরা তার কোন কথার জবাব দিলেই তিনি তাদের জামাত শিবিরের আখ্যা দিয়ে বিভিন্ন ভাবে হেনস্থা করতো। এছাড়াও আফরোজা আক্তার ডিউ এর বিরুদ্ধে নিয়মিত স্কুলে না আসা, ক্ষমতার অপব্যবহার, ক্লাস না নেওয়া, স্কুলের মার্কেট নিজের এবং স্বামীর নামে করে নেওয়া, স্কুল উপস্থিত না হয়ে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া, স্কুলে আগত অভিভাবকদের সাথে খারাপ আচরণ করা, ইসলামী পোশাকে কোন ছাত্র-ছাত্রী স্কুলে আসলে তাদের জঙ্গি ট্যাগ দেওয়া এবং ক্লাস না নিয়েও প্রশাসনকে ম্যানেজ করে থানা পর্যায়ে সেরা শিক্ষক নির্বাচিত হওয়া সহ তার মেয়েদের রেজাল্ট জালিয়াতি করার মত গুরুতর অভিযোগের কথা শোনা যায়। জাল সনদের পাশাপাশি সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসাবে নিয়োগ পেতে ব্যক্তিগত সম্পর্ককে ব্যবহার করেন আফরোজা আক্তার ডিউ।

জানা গেছে, কুষ্টিয়ার তৎকালীন জেলা প্রশাসকের সাথে রাশেদুল ইসলাম বিপ্লব ও ডিউ দম্পত্তির দহরম মহরম সম্পর্ক তৈরী হয়। ডিসি বাংলাতো রাত-দিনের যে কোন সময় প্রবেশের সুযোগ ছিলো আফরোজা আক্তার ডিউ। এই সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে কুষ্টিয়া কালেক্টরেট স্কুল এন্ড কলেজের সহকারী প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ নেন আফরোজা আক্তার ডিউ।

একাধিক সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য মতে, নিয়োগকালে তার একাডেমিক কাগজপত্র যাচাই-বাচাই করা হয়নি। যেহেতু অনার্স এ তার তৃতীয় বিভাগ ছিলো একারনে বেসরকারী দারুল এহসান নামে (বর্তমানে ইউজিসি কতৃক কালো তালিকাভুক্ত ও হাইকোর্ট থেকে অবৈধ ঘোষিত) একটি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজী সাহিত্যে অনার্স ও মাষ্টার্স ডিগ্রী সংগ্রহ করেন ডিউ। ওই সার্টিফিকেট দিয়ে সহকারী প্রধানশিক্ষক হিসেবে অদ্যবদী চাকুরীরত আছেন। দারুল এহসান থেকে সংগ্রহ করা তার অনার্স সার্টিফিকেটের সিরিয়াল নম্বার-০৪৬৩৭ এবং মাষ্টার্সের সার্টিফিকেট নম্বর-০০৩৯৮১। উক্ত সিরিয়াল নম্বর দিয়ে ইউজিসি কতৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করা হলে তারা জানান, সার্টিফিকেট দুটি ভূয়া বা জাল।

এই বিষয়ে জেলা প্রশাসন কার্যালয়ের সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট (শিক্ষা ও কল্যাণ শাখা) মনিরা আকতার কার্যনির্বাহী সভার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, এখনও সভার সিদ্ধান্তের বিষয়ে রেজুলেশন হয়নি। আগামী কাল (আজ সোমবার) রেজুলেশন হলে আপনারা পেয়ে যাবেন।

কুষ্টিয়া কুষ্টিয়া কালেক্টরেট স্কুল এন্ড কলেজের প্রধান শিক্ষক মৃণাল কান্তি সাহা বলেন, কার্যনির্বহিী সভার সিদ্ধান্ত মোতাবেক তাকে (আফরোজা আক্তার ডিউ) চাকুরী থেকে স্থায়ী ভাবে অব্যহতি দেওয়া হয়েছে। সেই সাথে চাকুরীরত অবস্থায় সে যে অর্থ বেতন ও ভাতা বাবদ প্রতিষ্ঠান থেকে নিয়েছে সেই অর্থ উদ্ধারে সরকারী বিধি মোতাবেক আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।

জানতে চাইলে কুষ্টিয়া কালেক্টরেট স্কুল এন্ড কলেজের সভাপতি ও জেলা প্রশাসক আবু হাসনাত মোহাম্মদ আরেফীন বলেন, তদন্তে প্রমাণ হয়েছে উনি জাল সনদে চাকুরী নিয়েছিলো। আজ (গতকাল রবিবার ৫ অক্টোবর) কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় উনাকে স্থায়ীভাবে অপসারণের সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়েছে। এছাড়াও চাকুরীরত অবস্থায় উনি বেতন ভাতা বাবদ যে অর্থ নিয়েছেন তা ফেরৎ পেতে উনাকে পত্র দেওয়া হবে। যদি উনি ফেরৎ না দেয়, তাহলে উনার বিরুদ্ধে বিধি মোতাবেক আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।



banner close
banner close