ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের ইশতেহার ঘোষণা করেছে ইসলামি ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেল ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট ও ইসলামি ছাত্র আন্দোলন (ইশা) সমর্থিত প্যানেল সচেতন শিক্ষার্থী সংসদ।
সোমবার বিকেলে ডাকসু কার্যালয়ের সামনে শুরুতে শিবির সমর্থিত প্যানেলের ইশতেহার পাঠ করেন শিবির প্যানেলের এজিএস প্রার্থী মহিউদ্দিন খান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফ্যাসিবাদের চিহ্ন, ফ্যাসিবাদী কাঠামো, সংস্কৃতি ও চর্চার পুনরুৎপাদন রোধ করাসহ ৩৬ দফা ইশতেহার ঘোষণা করেছে শিবির সমর্থিত ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট।
৬টি বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়ে ইশতেহার বাস্তবায়ন করবে ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট। প্রথম যে ৬টি বিষয় অগ্রাধিকার দিবে তা হল— নিরাপদ ক্যাম্পাস, আবাসন সংকট সমাধান, নারী শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তা, চিকিৎসা সুবিধা ও স্বাস্থ্যসম্মত খাবার, উন্নত পরিবহন, কারিয়ার গঠনে পর্যান্ত তথ্য ও সেবা। এ ছাড়া বাকি ৬টি বিষয়ে তারা না-বোধক বিষয় উল্লেখ করে বলেন, কর্তৃত্ববাদী রাজনীতি, নির্যাতন ও সহিংসতা, গণরুম-গেস্টরুম কালচার, বৈষম্যমূলক নীতি ও আচরণ, মাদক, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, লাঞ্চের পরে আসেন কালচার, ইসলামোফোবিয়া ও সাইবার বুলিং বন্ধের করবেন বলে ইশতেহারে ঘোষণা করেন তারা। এজিএস প্রার্থী মহিউদ্দিন মোট ৩৬টি ইশতেহার ঘোষণা করেন।
এসবের মধ্যে রয়েছে ডাকসু নির্বাচনকে অ্যাকাডেমিক ক্যালেন্ডারের অন্তর্ভুক্ত করে প্রতি বছর নির্ধারিত সময়ে নির্বাচন বাস্তবায়ন করা। ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিষিদ্ধ ছাত্রলীগ কর্তৃর্ক নৃশংস হামলায় জড়িত সন্ত্রাসীদের একাডেমিক, প্রশাসনিক ও আইনি শাস্তি নিশ্চিত করা। একই সাথে সামা, মোফাজ্জল ও আবু বকর হত্যাসহ ফ্যাসিবাদী আমলে সংঘটিত সকল নিপীড়নের সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার নিশ্চিত করা।
প্রথম বর্ষ থেকে প্রত্যেক শিক্ষার্থীর বৈধ সিট নিশ্চিত করা। আবাসন সংকটের অস্থায়ী সমাধান হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রাইভেট প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে অস্থায়ী হোস্টেল বা মাসিক আবাসন ভাতার ব্যবস্থা করা এবং স্থায়ী সমাধান হিসেবে হল নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করা।
নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর খামা নিশ্চিতকরণে হল ও অন্যান্য ক্যান্টিন-ক্যাফেটেরিয়াতে পুষ্টিবিদের মাধ্যমে স্বল্পমূল্যে পুষ্টিকর বাবারের মেন্যু প্রণয়ন এবং ৩ মাস অন্তর খাবার মান পরীক্ষা করা। প্রত্যেক ফ্যাকাল্টিতে মানসম্মত ক্যাফেটেরিয়া ও ক্যান্টিনের ব্যবস্থা করা। আর্থিক সংকটে থাকা শিক্ষার্থীদের জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিশেষ ‘মিল ভাউচার’ চালু করা।
নারী শিক্ষার্থীদের জন্য নিরাপদ পরিবহন নিশ্চিত করা। ছাত্রী হলে পুরুষ কর্মচারী যথাসম্ভব কমিয়ে আনা এবং প্রক্টরিয়াল টিমে প্রয়োজনীয় সংখ্যক নারী সদস্য নিয়োগ দেওয়া। কমনরুমে নারী কর্মচারী নিয়োগ দেওয়া। মা শিক্ষার্থীদের জন্য ব্রেস্ট ফিডিং রুম এবং চাইল্ড কেয়ার কর্নার স্থাপন করা।
ছাত্রীদের জন্য ছাত্রী হলে প্রবেশের বিধি-নিষেধ শিথিল করা। বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচয়পত্র প্রদর্শন-সাপেক্ষে অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের হলে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া। ছাত্রী হলে অভিভাবকদের জন্য ‘গার্ডিয়ান লাউঞ্জ’ স্থাপন করা।
ছাত্রীদের জন্য মাতৃত্বকালীন ছুটির বিধান কার্যকর করা। মাতৃত্বকালীন সমায় পরীক্ষায় অংশগ্রহণের জন্য ক্লাসে উপস্থিতির বাধ্যবাধকতা শিথিল করা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের সেবাকেন্দ্রিক লাল ফিতার দৌরাত্ম্য নিরসন করে ‘পেপারলেস রেজিস্ট্রার বিল্ডিং’ গড়ে তোলা। উচ্চশিক্ষায় বিদেশে গমনেচ্ছু শিক্ষার্থীদের জন্য ‘ওয়ান স্টপ সার্ভিস’ চালু করা।
ডাকসু ওয়েবসাইট উন্নতকরণ এরং অ্যাপের মাধ্যমে ‘অ্যাকসেস টু রিসোর্সেস’ নিশ্চিত করা ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধি করা। শিক্ষক মূল্যায়ন পদ্ধতিকে আরও কার্যকর করা এবং প্রতিটি বিভাগে উন্নত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আদলে ‘মেন্টরশিপ প্রোগ্রাম’ চালু করা। প্রত্যেক ফ্যাকাল্টিতে ই-লাইব্রেরি ও কম্পিউটার সেন্টার স্থাপন করা। মানসিক স্বাস্থ্যসেবা ও কাউন্সেলিং সেবার পরিসর বৃদ্ধি করা। বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেল সেন্টার মেরামত ও আধুনিকীকরণের মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবার মান বৃদ্ধি করা এবং ডিইউএমসি চালুর মাধ্যেমে স্বাস্থ্যসেবাকে আরও বেশি সহজলভ্য করা।
মেডিকেল সেন্টারে চুক্তিভিত্তিক বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের নিয়োগ দেওয়া। বিশেষ করে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ নারী চিকিৎসাকর ব্যবস্থা করা। শিক্ষার্থীদের নিয়ে রিসার্চবিষয়ক কর্মশালা করা। আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় গবেষণা ফেষ্ট আয়োজন করা। স্মল রিসার্চ গ্র্যান্ট ও রিসার্চ ট্রাডেল গ্র্যান্ট চালু করা। গবেষণার পরিবেশ নিশ্চিত করা ও গবেষণা সহজলভ্য করা। নিয়মিত সেমিনার ও কনফারেন্স আযোজন করা এবং উচ্চমানের প্রকাশনা নিশ্চিত করা।
মহিউদ্দিন খান আরও বলেন, কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি, বিজ্ঞান লাইব্রেরি, হল লাইব্রেরি ও পাঠকক্ষে এবং ডিপার্টমেন্টের সেমিনার কক্ষ সম্প্রসারণ করা। এগুলোর আধুনিকায়ন নিশ্চিত করে রিসোর্সগুলো শিক্ষার্থীদের জন্য আরও সহজলভ্য করা। লাইব্রেরিসমূহ ডিজিটালাইজেশনের আওতায় নিয়ে আসা।
সারাদেশে বিভিন্ন বেসরকারি হাসপাতালের সাথে স্মারকচুক্তির মাধ্যমে শিক্ষার্থী ও তার অভিভাবকদের চিকিৎসার জন্য বিশেষ ছাড়ের ব্যবস্থা করা। স্বাস্থ্যবিমা-কেন্দ্রিক ভোগান্তি নিরসনে প্রশাসন বীমা প্রতিষ্ঠানের সাথে স্মারকচুক্তি করা। হলভিত্তিক প্রাথমিক স্বাস্বাসেবা চালু করা। ক্যাম্পাসের বিপণীকেন্দ্রে প্রয়োজনীয় ফার্মেসি স্থাপন করা। ফিজিক্যালি চ্যালেঞ্জেড শিক্ষার্থীদের জন্য ‘অদম্য মেধাবী শিক্ষাবৃত্তি’ চালু করা। আধুনিক ভাষা ইনষ্টিটিউটকে বৈশ্বিক মানদন্ডে উন্নীত করা। প্রত্যেক বিভাগে অন্তত একজন বিদেশি শিক্ষক চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া। ল্যাংগুয়েজ রিসার্চ সেন্টার প্রতিষ্ঠা করা।
ইশতেহারে মহিউদ্দিন আরও উল্লেখ করে বলেন, সফট স্কিল ডেভলপমেন্টের ওপর ওয়ার্কশপ আয়োজন করা। উচ্চশিক্ষা ও ক্যারিয়ার-বিষয়ক সেমিনার, কর্মশালার পাশাপাশি ক্যাম্পাসে জব ফেয়ার আয়োজন করা। তরুণ উদ্যোক্তাদের নিয়ে স্টার্ট-আপ সামিট আয়োজন করা। অ্যালামনাই নেটওয়ার্ক শক্তিশালীকরণের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক উন্নয়নে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা খাতে বরাদ্দ বাড়িয়ে লাইব্রেরিগুলোতে উন্নত ও আধুনিক যন্ত্রপাতি নিশ্চিত করা। সায়েনা ওয়ার্কশপ, CARS এবং CARASS-এর আধুনিকায়ন নিশ্চিত করা। গবেষণা সহায়ক সফটওয়্যার ও টুলসমূহের সহজলভাতা নিশ্চিত করা। বিশেষত, ইনিস্টিটিউট অব লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনলোজির (আইএলইটি) ল্যাবে আধুনিক মেশিনারিজ ক্রয় করার মাধ্যমে ল্যাবের কার্যকারিতা বৃদ্ধি ও ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে সমন্বয় করার মাধ্যমে চামড়াশিল্পে অবদান রাখার সুযোগ-ক্ষেত্র বৃদ্ধি করা।
কেন্দ্রীয় মসজিদ, হল মসজিদ, মন্দির ও অন্যান্য উপাসনালয় সমূহের অবকাঠামোগত সংস্কার ও উন্নয়ন করা। ছাত্রীদের ইবাদতের জন্য অ্যাকাডেমিক এরিয়া বিশেষ করে কার্জন হল এলাকায় উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিতকরণ। ক্যাম্পাসের সুষ্ঠু পরিবেশ বজায় রাখার লক্ষ্যে বহিরাগত যান-নিয়ন্ত্রণ, ভাসমান চক্র ও ভবঘুরেদের উচ্ছেদ করা। ক্যাম্পাস এরিয়ায় রেজিস্ট্রার্ড রিকশা প্রবর্তন ও ভাড়া তালিকা প্রণয়ন করা।
ইশতেহার পাঠের শেষে সমাপনী বক্তব্য দেন ভিপি প্রার্থী আবু সাদিক কায়েম। তিনি বলেন, ‘আমাদের জোট হচ্ছে শিক্ষার্থীদের জোট। জুলাই বিপ্লবের মাধ্যমে আমরা যেটিকে নো বলেছি, সেটি থেকে মুক্তি পেয়েছি।’
বিকেলে সাড়ে ৫টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু ভবনের সামনে ইশতেহার ঘোষণা করে ইসলামি ছাত্র আন্দোলন সমর্থিত প্যানেল সচেতন শিক্ষার্থী সংসদ। প্যানেলের ভিপি প্রার্থী ইয়াসিন আরাফাত ইশতেহার ঘোষণা করেন।
ইশতেহারে তুলে ধরা মৌলিক অঙ্গীকারসমূহ হলো- রেজিস্ট্রার ভবনের কার্যক্রম ডিজিটালাইজেশনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া; বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের তাদের দায়িত্ব পালনে বাধ্যকরণ এবং দূর্নীতি রোধ করে বাজেটের যথাযথ বাস্তবায়ন; ক্যান্টিনগুলোকে একটি সমন্বিত ব্যবস্থার আওতায় এনে খাবারের দাম কমানো ও মান বৃদ্ধি করা; সবার জন্য সিঙ্গেল বেড ও উন্নত আবাসন নিশ্চিত এবং হলে অনাবাসিক ছাত্রীদের জন্য কমনরুম স্থাপন করা; কালচারাল হেজিমনি (Cultural Hegemon), হিজাবফোবিয়া ও যৌন হয়রানি রোধ করা এবং জ্ঞান ও মত চর্চার উন্মুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করা; নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে ১৯৪৭, ১৯৭১ ও ২০২৪ এর চেতনাকে ধারণ করে Fourth Industrial Revolution (4iR) এর উপযোগী দেশপ্রেমিক নেতৃত্ব গড়ে তোলা; শিক্ষার্থীদের সকল আইনগত ও জরুরি সহায়তায় DU Help Desk চালু করা এবং শিক্ষা ও গবেষণার জন্য প্রযুক্তির সর্বাধুনিক সেবা নিশ্চিতে Super Computer স্থাপনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ; পরিবহন সংখ্যা বৃদ্ধি ও অ্যাপের মাধ্যমে Real Time Tracking ব্যবস্থা প্রবর্তন এবং নিরাপদ ক্যাম্পাস নিশ্চিতের লক্ষ্যে যানবাহন ও বহিরাগতদের প্রবেশ নিয়ন্ত্রণ করা।
এছাড়া লাইব্রেরি আধুনিকায়ন ও সম্প্রসারণ এবং ২৪ ঘণ্টা লাইব্রেরি খোলা রাখার ব্যবস্থা করা; স্বাস্থ্যবীমার দীর্ঘ প্রক্রিয়া সহজীকরণ এবং আবাসিক হলগুলোতে ফার্মেসি স্থাপন করা; গেস্টরুম ও র্যাগিং সহ সব ধরনের শিক্ষার্থী নির্যাতন রোধ এবং মাদক ও দূষণমুক্ত নিরাপদ ক্যাম্পাস নিশ্চিত করা; ক্যাম্পাসে নিয়মিত জব ফেয়ার আয়োজন এবং ওয়ান স্টপ ক্যারিয়ার সলিউশন সেন্টার, ক্যারিয়ার গাইডলাইন, ইন্টার্নশিপ ও স্কিল ট্রেনিং সেন্টার চালু করা; ইউরোপিয়ান একাডেমিক ফ্রেমওয়ার্ক-এর Erasmus Student Mobility এর ন্যায় বাংলাদেশে অনুরূপ প্রোগ্রাম গ্রহণ এবং এর ধারাবাহিকতায় তা দক্ষিণ এশিয়ায় বাস্তবায়ন করা।
উল্লেখ্য, ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী আগামী ৯ সেপ্টেম্বর সকাল ৮টা থেকে বেলা ৪টা পর্যন্ত ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচনের ভোট গ্রহণ অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা রয়েছে।
আরও পড়ুন:








