কুড়িগ্রামের রাজীবপুর উপজেলায় "জাউনিয়ার চর বুদ্ধি প্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক বিদ্যালয়" নামে একটি ভুয়া শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলে চাকরির আশ্বাসে প্রায় ১ কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে স্থানীয় জামায়াত নেতা আনিছুর রহমান ও তার ভাজতী জামাই মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুলের বিরুদ্ধে। এতে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন অন্তত ২১টি পরিবার।
ভুক্তভোগী ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পর তারা স্কুলটি প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে ভালো বেতনের চাকরির প্রলোভন দেখিয়ে ২০১৭ সালে আনিছ ও বাবুল প্রত্যেক ভুক্তভোগীর কাছ থেকে মোটা অঙ্কের ঘুষ গ্রহণ করেন।
একাধিক ভুক্তভোগীর সঙ্গে কথা বলে বাংলা এডিশনের অনুসন্ধানে প্রতারণার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তারা জানান, চাকরির আশায় কেউ গরু বিক্রি করে, কেউ ঋণ করে টাকা জোগাড় করেন। মোহনগঞ্জ ইউনিয়নের বেহুলা-মোস্তফা দম্পতি বলেন, “আমাদের মেয়েটি মেধাবী ছাত্রী ছিল। আনিছুর রহমান একাধিকবার বাসায় এসে প্রস্তাব দেওয়ার পর আমরা রাজি হই। পরে টাকার জন্য চাপ দিলে গরু বিক্রি ও ঋণ করে টাকা দিই।” কিন্তু আজ প্রায় ৮ বছর হয়ে গেলো চাকরির কোনো খবর নাই। টাকা ফেরত চাইলে হুমকি দেয়। আমরা যখন টাকা দেই তখন সাক্ষী হিসেবে ফরিজল মেম্বার কে সাথে নিয়েছিলাম। তার হাত দিয়েই আনিস-কে টাকা দিয়েছি।
রাজীবপুর সদর ইউপি সদস্য ফরিজল হক এঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, আমার হাত দিয়ে আনিছ কে ২ লাখ টাকা দিয়েছি। প্রথমে দেড় লাখ, পরে ৫০ হাজার। টাকা নিয়েছে প্রায় ৮ বছর হলো এখনও চাকরি দেয় নাই৷
অন্যদিকে, মোয়াজ্জেম হোসেন বাবুল ভুক্তভোগী নারী হাসনা হেনার কাছ থেকে টাকা নেওয়ার সময় ওই নারীর ডাইরিতে লিখিত দিয়েছেন। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে কি জন্য এবং কত টাকা বাবুল হাসনা হেনার নিকট থেকে নিয়েছে। এর প্রমাণও হাসনা হেনা বাংলা এডিশনের অনুসন্ধান টিমের কাছে দিয়েছেন। তবে এঘটনা প্রথমে স্বীকার করলেও পরবর্তীতে বাবুল বলেন, এটা আমার সাক্ষর না। অন্য একটি প্রশ্নের জবাবে মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, আমি ১ লাখ টাকা তাকে ফেরত দিয়েছি।
ভুক্তভোগী নারী হাসনা হেনা অভিযোগ করে বলেন, চাকরি দেওয়ার নামে যে প্রায় ১ কোটি টাকা আনিছ ও বাবুল নিয়েছে, তা দিয়ে তাদের নিজেদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। আনিছ একটা চাকরির প্রক্সি দিতে গিয়ে আটক হয়ে জেলে ছিল পরে আমাদের টাকা দিয়ে বাবুল আনিছকে ছাড়িয়ে নিয়ে এসেছে। আর আনিছ আগে একটি ভাঙাচোরা মোটরসাইকেল চালাতেন বর্তমানে সাড়ে ৩ লাখ টাকার মোটরসাইকেল চালায়। এগুলো সব আমাদের টাকায় করা। বাবুল তার স্ত্রীর চাকরি, নিজের বেতন করা, বাড়িতে গরুর খামার ও রাজীবপুর বাজারে তার রড-সিমেন্টের ব্যবসা গড়ে তুলেছেন। এরমধ্যে এতো গুলো বছর পার হয়েছে গেছে অথচ স্কুলটি সর্বশেষ খোলা হয়েছিল ৫ বছর আগে, এরপর থেকে সেখানে কোনো কার্যক্রম আর দেখা যায়নি।
স্থানীয়রা জানায়, সব শেষ ২০২০ সালে স্কুলটি খোলা দেখেছেন তারা। এরপর আর কেউ ওই স্কুলে যায়নি। বর্তমানে সেখানে খোর খুটো রাখা হয়েছে।
বিদ্যালয়ের জমিদাতা আবুল কাশেম বলেন, “আমি দান হিসেবে জমি দিয়েছিলাম। এখন যারা প্রতারণা করে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া উচিত।”
স্কুলটির অনুমোদন পেতে সে-সময় রাজীবপুর উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক আজিম উদ্দিন কে সভাপতি করা হয়েছিল বলে একটি সুত্র জানায়। বাংলা এডিশন কে এঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করেন তৎকালীন যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান উপজেলা আওয়ামিলীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আজিম উদ্দিন। তিনি বলেন, আমাকে একটি অনুষ্ঠানে গিয়ে সভাপতি ঘোষণা দেয়। আর আমি যেহেতু সে-সময় যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলাম অনুমোদন পেতে সুবিধা হতো এজন্যই আমাকে সভাপতি করেছিল। আমি এটা নিয়ে সুপারিশও করেছিলাম। শুধু এটা না আব্দুল হাই কমান্ডারের টা নিয়েও সুপারিশ করেছিলাম। আজিম উদ্দিন আরও বলেন, আনিছ ৫ তারিখের আগে ছিল আওয়ামিলীগ, আর ৫ তারিখের পর সে খুব বড় জামায়াতের নেতা হয়ে গেছে। জাকির মন্ত্রীর সময় আনিছ যতগুলো প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রান্না নির্মাণ করা হয়েছে সে-সব গুলোর কাজ আনিছ করেছে। সে মন্ত্রীকে ব্যবহার করে টিআর কাবিখা/কাবিটাও নিয়েছিল।
অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় জামায়াত নেতা আনিছুর রহমান রাজীবপুর থানায় জামায়াতের দায়ের করা একটি মামলায় উপজেলা আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল হোসেন ও উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক বায়েজিদ ইসলাম বিজয়-কে বাঁচানোর জন্য তাদের পরিবারের কাছে টাকা দাবি করেন।
এবিষয়ে রাজীবপুর উপজেলা আওয়ামিলীগেী সাংগঠনিক সম্পাদক আবুল হোসেন বাংলা এডিশনকে বলেন, “আনিছ বলেছে-দেখো সবই তো বোঝো, টাকা ছাড়া কিছু হয় না। ২ লাখ টাকা খরচ করো, আমি বলে দিচ্ছি-তাহলে ওরা বাড়িতেই থাকতে পারবে।”
তবে আনিছুর রহমান বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, “আমি টাকা চাইনি। আমি শুধু বলেছি, থানায় গিয়ে ১-২ লাখ টাকা দিয়ে নাম কেটে নেন।” অথচ মালার এজাহারে তাদের নাম-ই পাওয়া যায়নি।
এবিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী কুড়িগ্রাম জেলা আমীর মাওলানা আব্দুল মতিন ফারুকী বলেন, “এটি আমাদের সংগঠনের পরিপন্থী কাজ। যদি কোনো ব্যক্তি এমনটি করে থাকে, তাহলে তার বিরুদ্ধে অবশ্যই শোচনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
জামায়াত নেতার এমন কর্মকাণ্ডে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন জুলাই যোদ্ধারা। তারা বলেন, “যাদের হাতে আমাদের ভাই শহিদ হয়েছেন, আজ জামায়াতের নেতা সেই আওয়ামীলীগের নেতাকর্মীদের রক্ষা করতে তৎপর হয়ে উঠেছে!”
আরও পড়ুন:








