রবিবার

১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫ ৩০ অগ্রহায়ণ, ১৪৩২

‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে অনেক কথা হলেও তা দমনে কার্যকর উদ্যোগ নেই’

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ২৪ আগস্ট, ২০২৫ ১৮:৪৯

শেয়ার

‘দুর্নীতির বিরুদ্ধে অনেক কথা হলেও তা দমনে কার্যকর উদ্যোগ নেই’
ছবি সংগৃহীত

দুর্নীতির বিরুদ্ধে অনেক কথা হলেও তা দমনে কার্যকর তেমন কোনো উদ্যোগ এখনও চোখে পড়েনি। অভ্যুত্থানের পর নতুন বাংলাদেশ আশা করলেও তা পাওয়া যায়নি।

রোবিবার ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রি (ডিসিসিআই) আয়োজিত ‘বেসরকারিখাতের দৃষ্টিতে বাংলাদেশের অর্থনীতির বিদ্যমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ পর্যালোচনা শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা এ কথা বলেন।

সেমিনারে সিপিডির সম্মানিত ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, মূল্যস্ফীতি কমাতে পারলেও মূল্যস্তর বেশ উপরে চলে এসেছে, মানুষের ক্রয়ক্ষমতার অবনমনের এ বিষয়টি বেশ আশঙ্কার। বন্ডেড ওয়ারহাউস ও ব্যাংক-টু-ব্যাংক এলসি সুবিধার কারণে তৈরি পোশাক খাত আজকে এ পর্যায়ে এসেছে, তাই রপ্তানির সম্ভাবনাময় অন্যান্য খাতগুলোকে এধরনের সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।

তিনি বলেন, দুর্নীতির বিরুদ্ধে অনেক কথা হলেও তা দমনে কার্যকর তেমন কোনো উদ্যোগ এখনও চোখে পড়েনি। ডিজিটালাইজেশন প্রক্রিয়াটি আমরা প্রয়োজনের নিরিখে বাস্তবায়ন করতে পারিনি, ফলে ট্যাক্স-জিডিপির অনুপাত তেমন আশাব্যঞ্জক নয়, কেবল রাজস্ব আদায় বেশি হলেই এসএমইদের বেশি সহায়তা দেওয়া সম্ভব হবে। আমাদের এডিপি বাস্তবায়ন পুরোটাই চলছে ঋণের উপর, যেটা কোনোভাবেই টেকসই প্রক্রিয়া নয়, তাই অভ্যন্তরীণ সঞ্চয় ও কর আহরণ বাড়ানোর উপর বেশি হারে মনোনিবেশ করতে হবে।

তিনি আরো বলেন, এলডিসি পিছিয়ে নেওয়ার জন্য আবেদন করা যেতে পারে, তবে আমাদেরকে প্রস্তুতি ঘাটতি রাখা যাবে না, যেন ব্যবসা সহায়ক পরিবেশ উন্নয়নে ঘাটতি না পড়ে।

সেমিনারের মূল প্রবন্ধে ডিসিসিআই সভাপতি তাসকীন আহমেদ ২০২৪-২৫ অর্থবছরের জানুয়ারি-জুন সময়কালে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, মুদ্রানীতি, মূল্যস্ফীতি, বেসরকারি বিনিয়োগ, বৈদেশিক বিনিয়োগ, কৃষি, শিল্প ও সেবা খাত, সিএমএসএমই, তথ্যপ্রযুক্তি, জ্বালানি ও বিদ্যুৎ, লজিস্টিক অবকাঠামো, দক্ষতা উন্নয়ন এবং আর্থিক খাতের উপর বিস্তারিত আলোকপাত করেন।

তাসকীন বলেন, ২০২৫ অর্থবছরে বেসরকারি বিনিয়োগ জিডিপির ২২.৪৮ শতাংশে নেমে এসেছে, যা গত পাঁচ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন এবং বিদ্যমান অবস্থার আলোকে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরিয়ে আনতে হলে ব্যাংক খাতে স্থিতিশীলতা আনয়ন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতা দূর করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে অভিমত জ্ঞাপন করেন, যাতে ব্যবসা-বিনিয়োগ প্রক্রিয়া সহজ করা সম্ভব হবে।

তিনি বলেন, আমরা দুর্নীতিমুক্ত সমাজ চাই, অভ্যুত্থানের পর আমরা একটি নতুন বাংলাদেশ চেয়েছিলাম, তবে সেটি পাইনি। এছাড়াও কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে রিজার্ভসহ সামগ্রিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতার জন্য উদ্যোগ থাকলেও কর আহরণের পরিমাণ বাড়াতে এনবিআরকে আরো উদ্যোগী হতে হবে, যদিও এ ধরনের কোনো উদ্যোগ পরিলক্ষিত হচ্ছে না, বরং হয়রানি অনেকগুণে বেড়েছে।

তাসকীন আহমেদ বলেন, এলডিসি উত্তরণে আমরা ভীত নই, তবে বৈশ্বিক অস্থিরতা এবং আভ্যন্তরীণ আন্দোলন বিক্ষোভ এবং সর্বশেষ ট্রাম্প কর্তৃক পারস্পরিক শুল্ক আরোপের উদ্যোগ এ পরিস্থিতি আরো অসহনীয় করে তুলছে। তাই আরো কিছুটা সময় পেলে আমরা নিজেদের প্রস্তুতি সম্পন্ন করতে পারব এবং এ উদ্যোগে সরকারি-বেসরকারিখাতের যৌথ উদ্যোগ একান্ত অপরিহার্য বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।

সেমিনারে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য (সচিব) ড. মঞ্জুর হোসেন প্রধান অতিথি হিসেবে তার বক্তব্য বলেন, দেশের ম্যাক্রো-ইকোনোমি কিছুটা হলেও স্থিতিশীল পর্যায়ে আছে এবং রিজার্ভ ৩০ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে, যা স্বস্তির বিষয়। মূল্যস্ফীতি বেশ কমেছে, তবে চালের মূল্য ক্রমাগত বাড়ছে। তাই এটি নিয়ন্ত্রণ করা গেলে মূল্যস্ফীতি আরো কমতে পারে। তবে শুধু ঋণের সুদ হার বেশি থাকা না, বাণিজ্যিক সহায়ক পরিবেশ অনুপস্থিতির কারণে বিনিয়োগ বাড়ছে না, সেটি খতিয়ে দেখার উপর তিনি জোরারোপ করেন। সেই সঙ্গে মূল্যস্ফীতি না বাড়ানোর পাশাপাশি বিনিয়োগ যেন হ্রাস না হয়ে সেদিকে বেশি নজর দিতে হবে। অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি কমে গেছে, এমতাবস্থায় বেসরকারিখাতে ঋণ প্রবাহ বাড়ানোর কোন বিকল্প নেই বলে তিনি মত প্রকাশ করেন। কেন্দ্রীয় ব্যাংক কর্তৃক ডলার না কিনে, তা বাজারের উপর ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে তিনি অভিমত জানান।

তিনি বলেন, সরকার এলডিসি গ্রাজুয়েশনের বিষয়টি ইতিবাচক হিসেবে দেখছে, তবে আমাদেরকে সামগ্রিক প্রস্তুতির বিষয়ের উপর নজর দিতে হবে, পাশাপাশি উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর উপর গুরুত্ব দিতে হবে। তিনি আরো বলেন, অর্থনীতিকে খাদের কিনারা থেকে উঠে এসেছে, এমতাবস্থায় সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির টেকসই রূপান্তরের উপর বেশ গুরুত্ব দেওয়ার পাশাপাশি বিনিয়োগ সম্প্রসারণ এবং বিশেষকরে ব্যাংক খাতকে ঢেলে সাজানোর আহ্বান জানান।

এছাড়াও অনুষ্ঠানের নির্ধারিত আলোচনায় বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)-এর মহাপরিচালক ড. এ কে এনামুল হক, বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক (গবেষণা), মুদ্রানীতি বিভাগ মাহমুদ সালাহউদ্দিন নাসের, পরিচালক (এসএমই ও স্পেশাল প্রোগ্রামস ডিপার্টমেন্ট) নওশাদ মুস্তাফা এবং এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)’র দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের অর্থনৈতিক কর্মকর্তা মো. রাবিউল ইসলাম অংশগ্রহণ করেন।

বিআইডিএস-এর মহাপরিচালক ড. এ কে এনামুল হক বলেন, অর্থনীতির বর্তমান অবস্থা মন্দের ভালো, অবস্থা উন্নয়ন দেখা যাচ্ছে তবে দীর্ঘ সময়ের জন্য তা কাঙ্ক্ষিত নয়। তিনি উল্লেখ করেন, দুর্নীতি যে খুব একটা কমেছে তা বলা যাবে না, অর্থনীতিকে বাঁচাতে হলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হবে এবং দুর্নীতির কারণে শুধু বদলি দিয়ে শাস্তি দিলে হবে না, মানুষের ভিতরকার পরিবর্তন প্রয়োজন। তিনি বলেন, আমাদের রপ্তানির চেয়ে আমদানিতে গ্রোথ বেশি, যেটা মোটেও কাম্য নয় এবং টাকা পাচার পশ্চিমের দেশগুলোতে সহজ বলে আমরা রপ্তানির ক্ষেত্রে পশ্চিমাদেশগুলোর দিকে বেশি ঝুঁকছি। দেশের কৃষিখাতের প্রবৃদ্ধি বেশ কম, কৃষিকে শিল্পের কাছাকাছি নিয়ে যেতে হবে এবং ব্যাংকিং কার্যক্রমে আমূল পরিবর্তন আনার কোন বিকল্প নেই।

তিনি আরো বলেন, মাত্র ২৩ লাখ করদাতাদের নিয়ে দেশকে বেশি দূর যাওয়া সম্ভব নয়, তাই করদাতা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই, এনবিআরের মূল কাজ হলো করদাতা বাড়ানো, যদিও তার হয়রানি করতে বেশি আগ্রহী।

বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিচালক (মুদ্রানীতি বিভাগ) মাহমুদ সালাহউদ্দিন নাসের বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতি এখন বেশ কঠোর বলে বেসরকারিখাতের অভিযোগ রয়েছে, তবে আমরা বেসরকারিখাতের সহনীয় পরিবেশ তৈরির লক্ষ্যে কাজ করছি। তিনি বলেন, সামগ্রিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা না আসলে ব্যবসা পরিচালনা, বিনিয়োগ আকর্ষণ ও মুনাফা অর্জন সম্ভব নয়। তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি হ্রাস পেলেই ঋণের সুদ হার হ্রাসের বিষয়টি সক্রিয়ভাবে বিবেচনা করা হবে। এছাড়াও জ্বালানি স্বল্পতা, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতির কারণেও বিনিয়োগ কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় আসছে না, শুধুমাত্র উচ্চ সুদহার এককভাবে দায়ী নয়। এছাড়াও দেশের উৎপাদনশীল খাতে ঋণ প্রবাহ নিশ্চিতের পাশাপাশি টেকসহ উপায়ে ঋণ প্রবাহ বাড়ানোর উপর কেন্দ্রীয় ব্যাংক গুরুত্ব দিচ্ছে বলে তিনি অভিহিত করেন।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অপর পরিচালক (এসএমই ও স্পেশাল প্রোগ্রামস ডিপার্টমেন্ট) নওশাদ মুস্তাফা বলেন, ক্যাপিটাল মেশিনারি আমদানি কমে যাওয়া, জুলাই আন্দোলন এবং গতবছরের বন্যার কারণে বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ ছিল না। বর্তমান অবস্থায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোসহ উন্নয়ন সহযোগীদের সঙ্গে নিয়ে পরিস্থিতি উন্নয়নে কাজ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ডিজিটাল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা চালু হলে ঋণ বিতরণের খরচ হ্রাস পাবে। ক্লাস্টার উন্নয়নের জন্য ঢাকা চেম্বারসহ অন্যান্য বাণিজ্য সংগঠন এবং দাতা সংস্থাগুলোর সহায়তা দরকার, তবে অনেক সময় উন্নয়ন সহযোগীদের কঠোর নীতিমালা এসএমইদের ঋণ প্রাপ্তিতে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়। সেই সঙ্গে এসএমইদের ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের উপর তিনি জোরারোপ করেন।

এডিবির দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের অর্থনৈতিক কর্মকর্তা মো. রাবিউল ইসলাম বলেন, আমাদেরকে ট্রেড কানেকটিভিটি বাড়ানো এবং রপ্তানি বাজারের সঙ্গে এসএমইদের সংযোগ বৃদ্ধি এবং পণ্য পরিবহন খরচ হ্রাসের উপর জোরারোপ করেন। সেই সঙ্গে তিনি তৈরি পোশাক খাতে ম্যান মেইড ফাইবারের ব্যবহার বাড়ানো এবং চামড়া শিল্পে স্ট্যান্ডার্ড মেনে চলাসহ অন্যান্য সম্ভাবনাময় খাতের সক্ষমতা বাড়ানোর আহ্বান জানান।



banner close
banner close