শুক্রবার

৬ জুন, ২০২৫
২২ জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২
১০ , ১৪৪৬

বিপ্লবী বাজেট সম্ভব নয়, সংবাদ সম্মেলনে অর্থ উপদেষ্টা

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রকাশিত: ৪ জুন, ২০২৫ ০৭:০৯

শেয়ার

বিপ্লবী বাজেট সম্ভব নয়, সংবাদ সম্মেলনে অর্থ উপদেষ্টা
অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ।

২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট জনবান্ধব ও ব্যবসাবান্ধব হয়েছে উল্লেখ করেছেন অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেন, আমাদের সামনের পথ কঠিন। আমরা চেষ্টা করছি এনবিআরকে রিঅর্গানাইজ করতে। বাইরে থেকে ঋণ আনার প্রক্রিয়াটাও মোটামুটি নেগোশিয়েট করে ফেলেছি। আমি মনে করি আমরা একটি জনবান্ধব ও ব্যবসাবান্ধব বাজেট দিতে পেরেছি। অনেকে বলছে তোমরা আগের পদাঙ্ক অনুসরণ করেছ। হুট করেই যে আমরা একটা বিপ্লবী বাজেট দিয়ে দেব, সেটা তো সম্ভব না। বাজেটে একেবারে যে ইনোভেশন নেই, তা কিন্তু নয়। বাজেট দিয়েছি, এটা ওপেন থাকবে। কিছু সাজেশন আসবে। পরবর্তীতে ফাইনাল বাজেটটা আসবে। গতকাল মঙ্গলবার রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আয়োজিত ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।

অর্থ সচিব ড. মো. খায়রুজ্জামান মজুমদারের সঞ্চালনায় আয়োজিত এ সংবাদ সম্মেলনে পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ, স্বরাষ্ট্র ও কৃষি উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশির আহমেদ, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, বাংলাদেশ ব্যাংকের গর্ভনর ড. আহসান এইচ মনসুর, এনবিআর চেয়ারম্যান আবদুর রহমান খান প্রমুখ উপস্থিত রয়েছেন।

অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, সার্বিকভাবে আমি মনে করি চ্যালেঞ্জের মুখে আছি। একটু কোলাবোরেটিভ, সিমপেথেটিক হয়ে কাজ করবেন; সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে। আমরা চাই একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে যে, এত প্রতিকূলতার মধ্যেও ঘুরে দাঁড়িয়েছে। বাজেটের নির্যাস হলো সবার জীবন যাপনকে স্বচ্ছ করা, সামাজিক নিরাপত্তা বাড়ানো ও জীবনমান উন্নত করা।

বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর বলেছেন, আমাদের দুইটা বড় চ্যালেঞ্জ ছিল। তার মধ্যে একটি মূল্যস্ফীতি আরেকটি মুদ্রা বাজার। এখন মূল্যস্ফীতি কমতে শুরু করেছে আবার বিনিময় হারও স্থিতিশীল। আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে মূল্যস্ফীতি ৭ শতাংশে নেমে আসবে। তখন সুদহারও কমানো হবে। তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি ও এক্সচেঞ্জ রেট স্থিতিশীল না হলে জিনিসপত্রের দাম বাড়তো। এখন স্বস্তিতে এসেছে। এক্সচেঞ্জ রেট বাজারের ওপরে ছেড়ে দেওয়ার পরও পরিবর্তন হয়নি, অর্থাৎ এটাও স্থিতিশীল অবস্থায় রয়েছে। এতে আস্থা এসেছে। আগামীতে মূল্যস্ফীতি একটি ভালো জায়গায় যাচ্ছে।

গভর্নর বলেন, খাদ্য মূল্যস্ফীতি সাড়ে ১৪ শতাংশ ছিল, এখন তা নেমে সাড়ে ৮ শতাংশে এসেছে। যদিও খাদ্যবহির্ভূত (নন ফুড) মূল্যস্ফীতি একটু বেশি আছে। তবে এটিও কমছে, সাড়ে ১১ শতাংশ থেকে কমে সোয়া ৯ শতাংশে এসেছে। অন্যদিকে বিশ্ববাজারে খাদ্য, তেল-গ্যাসের দর কমছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি করেছে। আগামী জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে ৭ শতাংশে নেমে আসবে বলে আশা করছি।

স্বরাষ্ট্র ও কৃষি উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, আসন্ন ঈদ ও রোজার ঈদের বাজার তুলনামূলকভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখবেন আমরা এখন স্বস্তিতে আছি। ভোক্তাদের অধিকার নিয়ে যত কথা বলছি, কৃষকের অধিকার নিয়ে অতটা বলি না। এখন ভোক্তারা অল্প দামে আলু পেলেও কৃষকরা ন্যায্য দাম পাচ্ছেন না। এবার আদা, পেঁয়াজ, ভুট্টার উৎপাদনও বাম্পার হয়েছে। শীত ও গ্রীষ্মের একমাস ব্যবধানে কৃষকের সবজি নষ্ট হয়ে যায়। এজন্য আমরা ১০০টির মতো ছোট কোল্ড স্টোরেজ করছি। আলু এবং বীজের আলু রাখার জন্য আলাদা করে বড় চারটি কোল্ড স্টোরেজ করে দিচ্ছি। আগামী সবজি ওঠার আগেই এসব কোল্ড স্টোরেজগুলো তৈরি হয়ে যাবে। পেঁয়াজ সংরক্ষণের জন্য প্রায় ৫০০টির মতো ঘর করে দিচ্ছি যেন চার-পাঁচ মাস এটি সংরক্ষণ করা যায়।

বাণিজ্য, বিমান, বস্ত্র ও পাট উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন বলেন, একসময় দেশের অর্থনীতি খাদের কিনারায় পৌঁছে গিয়েছিল। প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা প্রায় ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। পূর্ববর্তী প্রধানমন্ত্রী নিজেই স্বীকার করেছিলেন-দেশে দুর্ভিক্ষের শঙ্কা ছিল। সেই ভয়াবহ পরিস্থিতি থেকে আমরা ঘুরে দাঁড়িয়েছি। আমরা সিন্ডিকেট ভেঙে প্রতিযোগিতামূলক মার্কেটপ্লেস তৈরি করেছি, যা অর্থনীতিতে স্বচ্ছতা ফিরিয়েছে। তিনি বলেন, বাজার ব্যবস্থার ওপর সরকারের হস্তক্ষেপ নয় বরং নীতি সহায়তা ও নিয়ন্ত্রিত স্বাধীনতা বজায় রেখে কাজ করা হচ্ছে। এতে করে ব্যবসা-বাণিজ্য যেমন গতি পেয়েছে, তেমনি মূল্যস্ফীতির চাপ কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে।

জ্বালানি উপদেষ্টা মোহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, প্রস্তাবিত বাজেটকে একটি ব্যতিক্রমী, অসঙ্গতি কমানোর এবং অপচয় কমানোর বাজেট। তিনি বলেন, আমি এ বাজেটকে একটি ব্যতিক্রমী বাজেট বলব। এটা অসংগতি কমানোর বাজেট, অপচয় কমানোর বাজেট। আমরা জ্বালানি বিভাগ থেকে এলপিজি গ্যাসের দাম কমানোকে সমর্থন করছি। পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, বাজেট সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন হবে। এ বাজেট অনেক বেশি বাস্তবসম্মত। আমাদের চাহিদা বেশি, কিন্তু কাঠামোগত কারণে রাজস্ব আদায় করতে পারছি না। বাজেটকে অনেকে গতানুগতিক বলছে। তবে সামাজিক শিক্ষা, স্বাস্থ্য বাজেট বরাদ্দ বেশি হয়েছে। বাজেট একটা চলমান প্রক্রিয়া। প্রস্তাবিত বাজেট ব্যস্তবমুখী এবং মিতব্যয়ী বাজেট হয়েছে। আমরা বাজেটের মাধ্যমে ঋণ নিয়ে ঋণ পরিশোধের দুষ্ট চক্র থেকে বের হতে চাই। তবে এক বাজেটে এটা হবে না। তিনি বলেন, উন্নয়ন প্রকল্প সবই আগের সরকারের চলমান প্রকল্পে। আগে অর্থ সংস্থানও বিবেচনা করা হয়নি। ২০ থেকে ৩০ নতুন প্রকল্প বাকিগুলো পুরাতন প্রকল্প। আরেক প্রশ্নের জবাবে ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ইতোমধ্যেই সরকারি ক্রয় নীতি অনুমোদন পেয়েছে। এখন বিধিবিধান তৈরি হলেই এটি বাস্তবায়ন শুরু হবে সরকারি ক্রয় নীতি আগে ছিল না। অনেক দিন ধরেই আমরা বলছিলাম একটি সুসংগঠিত নীতিমালা থাকা দরকার। এখন সেটি অনুমোদিত হয়েছে। পরিকল্পনা উপদেষ্টা জানান, শতভাগ ই-টেন্ডার নিশ্চিত করা হবে। সরকারি ক্রয়ের জন্য এখন পর্যন্ত যেসব প্রথাগত পদ্ধতি অনুসরণ করা হচ্ছিল, তাতে অনেক সময় ন্যায্য প্রতিযোগিতা ও উদ্ভাবনী উদ্যোগ বাধাগ্রস্ত হতো। নতুন নীতিতে সেসব সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা করা হয়েছে।

প্রস্তাবিত ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে কালোটাকা সাদা করার জন্য সরাসরি কোনো সুবিধা রাখা হয়নি বলে জানিয়েছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান আব্দুর রহমান খান। এনবিআর চেয়ারম্যান জানান, আগের মতো কোনো বিশেষ সুযোগ নেই, তবে নির্দিষ্ট খাতে অতিরিক্ত কর পরিশোধ করে কেউ চাইলে তার অপ্রদর্শিত আয়কে ব্যবহারের সুযোগ থাকছে। এটা মূলত কালোটাকা সাদা করার সুযোগ নয়। বরং নির্দিষ্ট খাতে অতিরিক্ত কর দিয়ে যেকোনো অপ্রদর্শিত অর্থ ব্যবহারের একটা পথ রাখা হয়েছে। তিনি বলেন, এবার বাজেটে দুটি নির্দিষ্ট সুযোগ রাখা হয়েছে। তার মধ্যে একটি হলো কেউ যদি অপ্রদর্শিত অর্থ দিয়ে কোনো ফ্ল্যাট বা জমি কেনেন, তাহলে নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে কিছুটা বাড়তি হারে কর দিয়ে সেটি বৈধ করতে পারবেন। তবে তার বিরুদ্ধে কোনো সংস্থা যেমন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), আয়কর বিভাগ কিংবা ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)-এর তদন্ত চালাবে না। অন্যদিকে, দ্বিতীয় সুযোগটি হলো-যদি কেউ নিজের নামে থাকা জমিতে অপ্রদর্শিত অর্থে বাড়ি নির্মাণ করেন, তাহলে তাকে দ্বিগুণ হারে কর দিতে হবে। এ অতিরিক্ত কর পরিশোধ করলেই তার বিনিয়োগ আইনগতভাবে প্রশ্নবিদ্ধ হবে না। এনবিআর চেয়ারম্যান বলেন, গত বছর (আগস্ট ২০২৪) থেকেই কালোটাকা বৈধ করার বিশেষ সুযোগ পুরোপুরি বাতিল করা হয়েছে। এবারও তার ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয়েছে।

banner close
banner close